গাঁয়ে পাকা স্টেজ, অঢেল সাজ-সরঞ্জাম, মায় ইলেটিক লাইট আর ডায়নামো। যাকে বলে ষোল কলা। সেখানকার সখের থিয়েটারের উৎসাহ যে একটু তেজালো হবে তাতে সন্দেহ কি। নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সেই নাট্যসভার সভাপতি—তার নিজেরও লাহিত্যসাধনার মূলধারা ছিল এই নাট্যসাহিত্য। তা ছাড়া তিনি কৃতকীর্তি—তার নাটক অভিনীত হয়েছে কলকাতায়। তারাশঙ্কর ভাবল, জুনেই বুঝি সুগম পথ, অমনি নাটক লিখে একেবারে পাদপ্রদীপের সামনে চলে আসা। খ্যাতির তিলক না পেলে সাহিত্য বোধহয় জলের তিলকের মতই অসার।
নাটক লিখল তারাশঙ্কর। নির্মলশিববাবু তাকে সাননে সংবর্ধনা করলেন—সখের থিয়েটারের রথী-সারথিরাও উৎসাহে-উদ্যমে মেতে উঠল। মঞ্চস্থ করলে নাটকখানা। বইটা এত জমল যে নির্মলশিববাবু ভাবলেন একে গ্রামের সীমানা পেরিয়ে রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া দরকার। তদানীন্তন আর্ট-থিয়েটারের চাইদের সঙ্গে নির্মলশিববাবুর দহরম-মহরম ছিল, নাটকখানা তিনি তাদের হাতে দিলেন। মিটমিটে জোনাকির দেশে বসে তারাশঙ্কর বিদ্যুৎদীপতির স্বপ্ন দেখলে। আর্ট-থিয়েটার বইখানি সযত্নে প্রত্যর্পণ করলে, বলা বাহুল্য অনধীত অবস্থায়ই। সঙ্গে সঙ্গে নির্মলশিববাবুর কানে একটু গোপনগুঞ্জনও দেয়া হল : মশাই, আপনি জমিদার মানুষ, আমাদের বন্ধুলোক, নাট্যকার হিসেবে ঠাঁইও পেয়েছেন আসরে। আপনার নিজের বই হয়, নিয়ে আসবেন, যে করে হোক নামিয়ে দেব। তাই বলে বন্ধুবান্ধব শালা-জামাই আনবেন না ধরে-ধরে।
নির্মলশিববাবু তারাশঙ্করের মামাশ্বশুর।
সবিষাদে বইখানি ফিরিয়ে দিলেন তারাশঙ্করকে। ভেবেছিলেন কথাগুলি আর শোনাবেন না, কিন্তু কে জানে ঐ কথাগুলোই হয়তে মনের মত কাজ করবে। তাই না শুনিয়ে পারলেন না শেষ পর্যন্ত, বললেন, তুমি নাকি অপাঙক্তেয়, তুমি নাকি অনধিকারী। রঙ্গমঞ্চে তোমায় স্থান হল না তাই, কিন্তু আমি জানি তোমার স্থান হবে বঙ্গমালঞ্চে। তুমি নিরাশ হয়ো না। মনোভদ মানায় না তোমাকে।
স্তোকবাক্যের মত মনে হল। রাগে-দুঃখে নাটকখানিকে অলঃ উনুনের মধ্যে গুঁলে দিল তারাশঙ্কর।
ভাবল সব ছাই হয়ে গেল বুঝি! পাদপ্রদীপের আলো বুঝি সব নিবে গেল। হয়ত গিয়ে ঢুকতে হবে কয়লাখাদের অন্ধকারে, কিংবা জমিদারি সেরেস্তার ধুলো-কাদার মধ্যে। কিংবা সেই গতানুগতিক শ্রীঘরে। নয়তো গলায় তিনকন্ঠী তুলসীর মালা দিয়ে সোজা বৃন্দাবন।
কিন্তু, না, পথের নির্দেশ পেয়ে গেল তারাশঙ্কর। তার আত্মসাক্ষাৎকার হল।
কি-এক মামুলি স্বদেশী কাজে গিয়েছে এক মফস্বলি শহরে। এক উকিলের বাড়ির বৈঠকখানায় তক্তপোশের এক ধারে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। শুয়ে-শুয়ে আর সময় কাটে না—কিছু একটা পড়তে পেলে মন্দ হত না হয়তো। যেমন ভাবনা তেমনি সিদ্ধি। চেয়ে দেখলো তক্তপোশের তলায় কি-একটা ছাপানো কাগজ-মতন পড়ে আছে। নিলাম-ইস্তাহার জাতীয় কিছু না হলেই হয়। কাগজটা হাত বাড়িয়ে টেনে নিল তারাশঙ্কর। দেখল মলাট-ছেঁড়া ধুলোমাখা একখানা কালিকলম।
নামটা আশ্চর্যরকম নতুন। যেন অনেক শক্তি ধরে বলেই এত সহজ। উলটে-পালটে দেখতে লাগল তারাশঙ্কর। কি-একটা বিচিত্র নামের গল্প পেয়ে থমকে গেল। গল্পের নাম পোনাঘাট পেরিয়ে—আর লেখকের নামও দুঃসাহসী-প্রেমেন্দ্র মিত্র।
এক নিশ্বাসে গল্পটা শেষ হয়ে গেল। একটা অপূর্ব আস্বাদ পেল তারাশঙ্কর, যেন এক নতুন সাম্রাজ্য আবিষ্কার করলে। যেন তার প্রজ্ঞানময় তৃতীয় চক্ষু খুলে গেল। খুঁজে পেল সে মাটিকে, মলিন অথচ মহত্বময় মাটি; খুঁজে পেল সে মাটির মানুষকে,উৎপীড়িত অথচ অপরাজেয় মানুষ। পতিতের মধ্যে খুঁজে পেল সে শাশ্বত আত্মার অমৃতপিপাসা উঠে বসল তারাশঙ্কর। যেন তার মন্ত্রচৈতন্য হল।
স্বাদু স্বাদু পদে পদে। পৃষ্ঠা ওলটাতে-ওলটাতে পেল সে আরেকটা গল্প। শৈলজানন্দর লেখা। গল্পের পটভূমি বীরভূম, তারাশঙ্করের নিজের দেশ। এ যে তারই অন্তরঙ্গ কাহিনী–একেবারে অন্তরের ভাষায় লেখা! মনের সুষমা মিশিয়ে সহজকে এত সত্য করে প্রকাশ করা যায় তা হলে! এত অর্থান্বিত করে। বাংলা সাহিত্যে নবীন জীবনের আভাস-আস্বাদ পেয়ে জেগে উঠল তারাশঙ্কর। মনে হল হঠাৎ নতুন প্রাণের প্লাবন এসেছে–নতুন দর্শন নতুন সন্ধান নতুন জিজ্ঞাসার প্রদীপ্তি-নতুন বেগবীর্যের প্রবলতা। সাধ হল সেও এই নতুনের বন্যায় পা ভাসায়। নতুন বসে কলম ডুবিয়ে গল্প লেখে।
কিন্তু গল্প কই? গল্প তোমার আকাশে-বাতাসে মাঠে-মাটিতে হাটেবাজারে এখানে-সেখানে। ঠিক মত তাকাও, ঠিক মত শোনো, ঠিক মত বুকের মধ্যে অনুভব করে।
বৈষয়িক কাজে ঘুরতে ঘুরতে তারাশঙ্কর তখন এসেছে এক চাষীগাঁয়ে। যেখানে তার আস্তানা তার সামনেই রসিক বাউলের আখড়া। সরোবরের শোভা যেমন পদ্ম, তেমনি আখড়ার শোভা কমলিনী বৈষ্ণবী।
প্রথম দিনই কমলিনী এসে হাজির—কেউ না ডাকতেই। হাতে তার একটি রেকাবি, তাতে দুটি সাজা পান আর কিছু মশলা। রেকাবিটি তারাশঙ্করের পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে প্রণাম করলে গড় হয়ে, বললে, আমি কমলিনী বৈষ্ণবী, আপনাদের দাসী।
শ্রবণলোভন কণ্ঠস্বর। অতুল-অপরূপ তার হাসি। সে-হাসিতে অনেক গভীর গল্পের কথকতা।
কি একটা কাজে ঘরের মধ্যে গিয়েছে তারাশঙ্কর, শুনল গোমস্তা কমলিনীর সঙ্গে রসিকতা করছে; বলছে, বৈষ্ণবীর পানের চেয়েও কথা মিষ্টি—তার চেয়েও হাসি মিষ্টি–