আর্য-পাবলিশংএ জমে উঠল আমাদের বারবেলা ক্লাব। সেই ক্লাবের কেন্দ্রবিন্দু শশাঙ্ক। বৃহস্পতিবার শশাঙ্কের কাগজের আপিসে ছুটি, আই সেদিনটা অহোরাত্রব্যাপী কীর্তন। এ শুধু সম্ভব হয়েছিল শশাঙ্কের ঔদার্যের জন্যে। নিজে যখন সে কবি আর সৌভাগ্যক্রমে হৃদয়ে ও দোকানে যখন সে এতখানি পরিসরের অধিকারী, তখন বন্ধুদের একদিনের জন্যে অন্তত আশ্রয় ও আনন্দ না দিয়ে তার উপায় কি? দোকানের কর্তা বলতে সে-ই, আর নিতান্ত সেটা বইয়ের দোকান আর দোতলার উপর বইয়ের দোকান বলে নিরন্তর খদ্দেরের আনাগোনায় আমাদের আড্ডার তালভঙ্গ হবার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু এত লোকের গুলতানির মধ্যে শশাঙ্ক নিজে কোথাও স্পষ্ট-স্ফুট হয়ে নেই। মধ্যপদ হয়েও মধ্যপদলোপী সমাসের মতই নিজের অস্তিত্বটুকুকে কুণ্ঠিত করে রেখেছে। এত নম্র এত নিরহঙ্কার শশাঙ্ক। অতিথিসৎকারক হয়েও সৎই থেকে গেল চিরদিন, কারকত্বের কণামাত্র অভিমানকেও মনে স্থান দিল না।
সাহিত্যিক-সাংবাদিক অনেকেই আসত সে আড্ডায়। কল্লোল সম্পর্কে এতাবৎ যাদের নাম করেছি তারা তো আসতই, তা ছাড়া আসত প্রমোদ সেন, বিজন সেনগুপ্ত, গোপাল সান্যাল, ফণীন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নলিনীকিশোর গুহ, বারিদবরণ বসু, রামেশ্বর দে, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, তারানাথ রায়, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, বিজয়ভূষণ দাশগুপ্ত, শচীন্দ্রলাল ঘোষ, বিনয়েন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিজা মুখোপাধ্যায়, অবিনাশ ঘোষাল, সন্ন্যাসী সাধুখাঁ এবং আরো অনেকে। এ দলের মধ্যে দুজন আমাদের অত্যন্ত অন্তিকে এসেছিল—বিবেকানন্দ আর অবিনাশ—দুজনেই প্রথমে সাহিত্যিক পরে সাংবাদিক। বিবেকানন্দ তখন প্রাণময় প্রেম বা প্রেমময় প্রাণের কবিতা লেখে, আর ভাগ্যের প্রতিরথ হয়ে জীবিকার সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। বেঁটে, বামুন আর বাঙাল—এই তিন ব নিয়ে তার গর্ব, যেন ত্রিগুণাত্মক ত্রিশূল ধারণ করে লে দিখিয়ে চলেছে। আরো এক ব–সে অধিকারী–সে তার তেজোতপ্ত নাম। মোটকথা, হস্তী অশ্ব রথ ও পদাতি—এই চতুরঙ্গে পরিপূর্ণ সৈনিক। অবিনাশ ক্ষয়োদয়রহিত একনিষ্ঠ সাধক–ফলাকাঙ্ক্ষাহীন। সহায়সম্পন্ন না হয়েও উপায়কুশল। মলয় হাওয়ার আশায় সারাজীবন সে পাখা করতে প্রস্তুত, এত শুদ্ধবুদ্ধিময় তার কাজ। সেই কাজের শুদ্ধিতে তার আর বয়স বাড়ল না কোনদিন। এদিকে সে পবিত্রর সমতুল।
বারবেলা-ক্লাবে, শশাঙ্কর ঘরে, আমাদের মুৎফরাক্কা মজলিস। কখনো খুনসুটি, ছেলেমানুষি, কখনো বা বিশুদ্ধ ইয়ার্কি। প্রমথ চৌধুরী মাঝে-মাঝে এসে পড়তেন। তখন অকালমেঘোদয়ের মত সবাই গম্ভীর হয়ে যেতাম, কিন্তু সে-গাম্ভীর্ষে রসের ভিয়ান থাকত। এক-একদিন এসে পড়ত নজরুল। ভাঙা হারমোনিয়ম একটা জুটত এসে কোত্থেকে, চারদিক সরগরম হয়ে উঠত। ওর প্রথম কীর্তন ‘কেন প্রাণ ওঠে কাঁদিয়া’ এই বারবেলা-ক্লাবেই প্রথম ও শুনিয়ে গেছে। কোন এক পথের নাচুনী ভিক্ষুক মেয়ের থেকে শিখে নিয়েছিল সুর, তারই থেকে রচনা করলে—রুমুঝুমু রুমুঝুমু কে এলে নূপুর পায়, আর তা শোনাবার জন্যে সটান চলে এল রাস্তার প্রথম আস্তানা শশাঙ্কর আখড়াতে।
তবু, এত জনসমাগম, তবু যেন কল্লোলের মত জমত না। জনতার জন্যেই জমত না। জনতা ছিল, কিন্তু ঘনতা ছিল না। আকস্মিক হুল্লোড় ছিল খুব, কিন্তু কল্লোলের সেই আকস্মিক স্তব্ধতা ছিল না। যেন এক পরিবারের লোক এক নৌকোয় যাচ্ছি না, ছত্রিশ জাতের লোক ছত্রভঙ্গ হয়ে চলেছি এক জাহাজে, উত্তেজ-উদ্বেল জল ঠেলে।
তবু নজরুল নজরুল। এসে গান ধরলেই হল, সবাই এক অলক্ষ্য সুরে বাঁধা পড়ে যেতাম। যৌবনের আনন্দে প্রত্যেক হৃদয়ে বন্ধুর স্পন্দন লাগত, যেন এক বৃক্ষে পল্লব-পরম্পরায় বসন্তের শিহরণ লেগেছে। একবার এক দোল-পূর্ণিমায় রামপুরে গিয়েছিলাম আমরা অনেকে। বোটানিক্যাল গার্ডেনস পর্যন্ত নৌকো নিয়েছিলাম। নির্মেঘ আকাশে পর্যাপ্ত চন্দ্র—সেই জ্যোৎস্না সত্যি-সত্যিই অমৃত-তরঙ্গিণী। ছিল। গঙ্গাবক্ষে সে রাত্রিতে সে নৌকোয় নজরুল অনেক গান গেয়েছিল-গজল, ভাটিয়ালি, কীর্তন। তার মধ্যে ‘আজি দোল পূর্ণিমাতে দুলবি তোরা আয়’, গানখানির সুর আজও স্মৃতিতে মধুর হয়ে আছে। সেই অনির্বচনীয় পরিপার্শ্ব, সেই অবিস্মরণীয় বন্ধুসমাগম, জীবনে বোধহয় আর দ্বিতীয় বার ঘটবে না।
২৪. তারাশঙ্করের আবির্ভাব
তারাশঙ্করেরও প্রথম আবির্ভাব কল্লোলে।
অজ্ঞাত-অখ্যাত তারাশঙ্কর। হয়তো পৈত্রিক বিষয় দেখবে, নয়তো কয়লাখাদের ওভারম্যানি থেকে শুরু করে পারমিট-ম্যানেজার হবে। কিংবা বড় জোর স্বদেশি করে এক-আধবার জেল খেটে এসে মন্ত্রী হবে।
কিন্তু বাংলা দেশের ভাগ্য ভালো। বিধাতা তার হাতে কলম তুলে দিলেন, কেরানি বা খাজাঞ্চির কলম নয়, স্রষ্টার কলম। বেঁচে গেল তারাশঙ্কর। শুধু বেঁচে গেল নয়, বেঁচে থাকল।
সেই মামুলি রাস্তায়ই চলতে হয়েছে তারাশঙ্করকে। গাঁয়ের সাহিত্য সভায় কবিতা পড়া, কিংবা কারুর বিয়েতে প্রীতি-উপহার লেখা, যার শেষ দিকে না বা প্রভুকে লক্ষ্য করে কিছু ভাবাবেশ থাকবেই। মাঝেমাঝে ওর চেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে হত না তা নয়। ডাক-টিকিটসহ গোটা কবিতা পাঠাতে লাগল মাসিকপত্রে। কোনোটা ফিরে আসে, কোনোটা আবার আসেই না—তার মানে, ডাক-টিকিটসহ গোটা কবিতাটাই লোপাট হয়ে যায়। এই অবস্থায় মনে শ্মশানবৈরাগ্য আসার কথা। কিন্তু তারাশঙ্করের সহিষ্ণুতা অপরিমেয়। কবিতা ছেড়ে গেল সে নাট্যশালায়।