গায়ে খদ্দরের গলাবন্ধ কোট। তারই একদিকের পকেটে কী ওটা শুঁড় বার করে রয়েছে। .
বুঝতে দেরি হল না শশাঙ্কর। শরৎচন্দ্রের পকেটে চামড়ার কেসে মোড়া একটি আস্ত জলজ্যান্ত রিভলবার।
সদ্য লাইসেন্স পাওয়ার পর ঐ ভায়োলেন্ট বস্তুটি শরৎচন্দ্র তাঁর নন-ভায়োলেন্ট কোটের পকেটে এমনি অবলীলায় কিছুকাল বহন করেছিলেন।
ওদিককার কোটের পকেটে আরো একটা জিনিস ছিল। সেটা কাগজে মোড়া। সেটা শশাঙ্ক দেখেনি। সেটা শরৎচন্দ্রের সতী গল্পের পাণ্ডুলিপি।
ঐ গল্পটিই তিনি দিতে এসেছিলেন কালি-কলমকে। তারই জন্যে অমনি হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছিলেন মুরলীধরকে। মুরলীধরকে না পেয়ে সোজা চলে গেলেন ভবানীপুরে—বঙ্গবাণীতে। সতীর পূতস্পর্শ পড়ল না আর মসীচিহ্নিত কালি-কলমে।
এদিকে ঐ দিনই মুরলীধর আর শৈলজা সকালবেলার ট্রেনে চলে এসেছে পানিব্রাস। শরৎচক্রের বাড়িতে গিয়ে শোনে, শরৎচন্দ্র সকালবেলার ট্রেনে চলে গিয়েছেন কলকাতা। এ যে প্রায় একটা উপন্যাসের মতন হল। এখন উপায়? ফিরবেন কখন? সেই রাত্রে। তাও ঠিক কি।
এতটা এসে দেখা না করে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। রাত্রে না হোক, পরদিন কিংবা কোনো একদিন তো ফিরবেন। সুতরাং থেকে যাওয়া যাক। কিন্তু শুধু উপন্যাসে কি পেট ভরবে?
শরৎচন্দ্রের ছোট ভাই প্রকাশের সঙ্গে শৈলজা ভাব জমিয়ে ফেলল। কাজেই থাকা বা খাওয়া-দাওয়ার কিছুরই কোনো অসুবিধে হল না।
রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি পালকির আওয়াজ শোনা গেল। আসছেন শরৎচন্দ্র।
কি জানি কেমন ভাবে নেবেন ভয় করতে লাগল দুই বন্ধুর। এত রাত পর্যন্ত তার বাড়ি আগলে বসে আছে ঘাপটি মেরে এ কেমনতর অতিথি!
পালকি থেকে নামতে লণ্ঠনটা তুলে ধরল শৈলজা। এমন ভাবে তুলে ধরল যাতে আলোর কিছুটা অন্তত তাদের মুখে পড়ে—যাতে তিনি একটু চিনলেও চিনতে পারেন বা! প্রতীক্ষমান বিদেশী লোক দেখে পাছে কিছু বিরক্তিব্যঞ্জক উক্তি করেন, তাই দ্রুত প্রণাম সেরেই মুরলীধর বলে উঠলেন : এই শৈলজা; আর শৈলজাও সঙ্গে-সঙ্গে প্রতিধ্বনি করল : এই মুরলীদা।
আরে, তোমরা? শরৎচন্দ্রের স্তম্ভিত ভাবটা নিমেষে কেটে গেল। আমি যে আজ দুপুরে তোমাদের কালি-কলমেই গিয়েছিলাম। কি আশ্চর্য—তোমরা এখানে? এলে কখন?
দুঃসংবাদটা চেপে গেলেন—ভাগ্যের কারসাজিতে কী সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে কালি-কলম। উচ্ছ্বলিত হয়ে উঠলেন আতিথেয়তার ঔদার্যে : তা বেশ হয়েছে–তোমরা এসেছ! খাওয়া-খাওয়া হয়েছে তো? অসুবিধে হয়নি তো কোন? কি আশ্চর্য–তোমরা আমার বাড়িতে আর আমি তোমাজের খুঁজে বেঁড়াচ্ছি! তা এইরকমই হয় সংসারে। একরকম ভাবি হয়ে ওঠে অন্যরকম। আচ্ছা তোমরা বোসো, আমি জামা-কাপড় ছেড়ে খেয়ে আসি। কেমন?
বলেই ভিতরে চলে গেলেন, এবং বললে বিশ্বাস হবে না, মিনিট পনেরোর মধ্যেই বেরিয়ে এলেন চটপট। তারপর শুরু হল গল্প–সে আর থামতে চায় না। মমতা করবার মত মনের মানুষ পেয়েছেন, পেয়েছেন অন্তরঙ্গ বিষয়—জীব আর জীবন—তাঁকে আর কে বাধা দেয়! রাত প্রায় কাবার হতে চলল, তরল হয়ে এল অন্ধকার, তবু তার গল্প শেষ হয় না।
তাঁকেও বারণ করবার লোক আছে ভিতরে। প্রায় ভোরের দিকে ডাক এল : ওগো, তুমি কি আজ একটুও শোবে না?
তক্ষুনি মুরলীদারা তাঁকে উপরে পাঠিয়ে দিলেন। যেতে-যেতেও কিছু দেরি করে ফেললেন। তাঁর লাইব্রেরি ঘরে মুরলীদাদের শোবার বিস্তৃত ব্যবস্থা করলেন। তাতেও যেন তাঁর তৃপ্তি নেই। বিছানার চারপাশ ঘুরে-ঘুরে নিজ হাতে মশারি গুঁজে দিলেন।
আমি একবার গিয়েছিলাম পানিত্ৰাস। একা নয়, শৈলজা আর প্রেমেনের সঙ্গে। ভাগ্য ভালো ছিল, শরৎচন্দ্র বাড়ি ছিলেন। আমি তো নগণ্য, নেতিবাচক উপসর্গ, তবুও আমারও প্রতি তিনি স্নেহে দ্রবীভূত হলেন। সারা দিন আমরা ছিলাম তার কাছে কাছে, কত-কী কথা হয়েছিল কিছুই বিশেষ মনে নেই, শুধু তার সেই সামীপ্যের সম্প্রীতিটি মনের মধ্যে এখনো লেগে আছে। আমাদের সেদিনকার বহুব্যঞ্জনব্যঞ্জিত অন্নের থালায় যে অদৃশ্য হস্তের স্নেহ-সেবা-স্বাদ পরিবেশিত হয়েছিল তাও ভোলবার নয়।
কথায়-কথায় তিনি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলেন : কার জন্যে, কিসের জন্য বেঁচে আছ?
মন্দিরের ঘণ্টার মত কথাটা এসে বাজল বুকের মধ্যে।
জীবনে কোথায় সেই জাগ্রত আদর্শ? কে সেই মানসনিবাস? কার সন্ধানে এই সম্মুখযাত্রা?
আদর্শ হচ্ছে রাতের আকাশের সুদূর তারার মত। ওদের কাছে পৌঁছুতে পারি না আমরা, কিন্তু ওদের দেখে সমুদ্রে আমরা আমাদের পথ করে নিতে পারি অন্তত।
সত্যরত হও, ধৃতব্রত। পার্বতী শিবের জন্যে পঞ্চানল জ্বেলে পঞ্চতপ করেছিলেন। তপস্যা করেছিলেন পঞ্চমুণ্ডির উপর বসে। নিরুত্থান তপস্যা। ইন্ধন না থাকে, তবুও আগুন নিভবে না। হও নিরিন্ধনাগ্নি।
যে শুধু হাত দিয়ে কাজ করে সে শ্রমিক, যে হাতের সঙ্গে-সঙ্গে মাথা খাটায় সে কারিগর, আর যে হাত আর মাথার সঙ্গে হৃদয় মেশায় সেই তো আর্টিস্ট। হও সেই হৃদয়ের অধিকারী।
কালি-কলমের আড্ডাটা একটু কঠিন-গম্ভীর ছিল। সেখানে কথন ছিল বেশি, উপকথন কম। মানে যিনি বক্তা তারই একলার সব কর্তৃত্ব ভোক্তৃত্ব। আর সব শ্রোতা, অর্থাৎ নিশ্চলজিহ্ব। সেখানে একাভিনয়ের ঐকপত্য। বক্তার আসনে বেশির ভাগই মোহিতলাল, নয়ত সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, নয়তো কখনো-সখনো সুরেন গাঙ্গুলী, নয়তো কোনো বিরল অবসরে শরৎচন্দ্র। কালি-কলমের আড্ডায় তাই মন ভরত না। তাই কালি-কলমের লাগোয় ঘরেই আর্য-পাবলিশিং-এ আমরা আস্তে-আস্তে একটা মনোম আড্ডা গড়ে তুললাম। অর্থাৎ কালি-কলমের সঙ্গে সংসর্গ রাখতে গিয়ে না শুদ্ধ শুষ্কতর্ক নিয়েই বাড়ি ফিরি।