আমার স্বাচ্ছন্দ্য মোরে হানিছে বিকার,
এই আলো এ বাতাস
যেন পরিহাস–
আমার সম্মান মোরে করে অপমান।–
ভূমাতেও নাহি সুখ, অমৃতেও নাহি অধিকার
–কে সহিবে আত্মার ধিক্কার!…
সুখ নাই পূর্ণতায়, তিক্ত প্রেয়সীর ওষ্ঠাধর
সভ্যতায় সুখ নাই, শত কোটী নর যার পর–
এ জীবন এত সুখহীন–বেদনাও হেথায় বিলাস!
কিংবা :
গাহি জয় জননী রতির!
এ ভুবনে প্রথমা গতির—
গাহি জয়–
যে গতির মাঝে ছিল জীবনের শত লক্ষ গতি
নিত্য নব আগতির
অনন্ত বিস্ময়।
স্বর্গ হতে আসিল যে রসাতলে নেমে
সকলের পাপে আর সকলের প্রেমে…
গাহি জয় সে বিজয়িনীর!
যে বিপুল যে বিচিত্র যে বিনিদ্র কাম
গাহি জয়—তারই জয়।
হেমন্ত সরকার কল্লোল যুগের কেউ নন একথা বলতে রাজি নই। তিনি আমাদের পক্ষে কিছু লেখেননি হয়তো কিন্তু বরাবর অনুপ্রাণনা দিয়ে এসেছেন। সুভাষচন্দ্রের সতীর্থ, নজরুলের বন্ধু, হেমন্তকুমার চিরকাল বন্ধন-বশ্যতা-না-মানা, অমেয়জীবী যৌবনের পক্ষে। তাই তিনি বহুবার আমাদের সঙ্গে মিলেছেন, আমরাও তার কাছ থেকে বহু আনন্দ নিয়ে এসেছি। উল্লাসে-উৎসবে বহু ক্ষণ-খণ্ড কেটেছে তার সাহচর্যে। তিনি বলতেন, যে কিছুই করে না, কিছুই বলে না, কিছুই হয় না, সেই শুধু নিন্দা এড়ায়। যে কিছু করে, বলে, বা হয়, সেই তো নিন্দা দ্বারা স্বীকৃত, সংবর্ধিত। চলতে-চলতে একবারও পড়ব না এতে কোনো মহত্ত্ব নেই, যতবার পড়ব ততবারই উঠব এতেই আসল মহত্ব। তাই যত গাল খাবে তত লিখবে। শত চীৎকারেও ক্যারাভেন থামেনি কোনোদিন।
বর্ধমানের বলাই দেবশর্মার চিঠি নিয়ে কল্লোল-আপিসে আসে একদিন দেবকী বসু, বর্তমানে এক জন বিখ্যাত ফিলম-ডিরেক্টর। চিঠিখানি পত্রবাহকের পরিচিতি বহন করছে—’ইনি আমার শক্তি কাগজের সহকারী’—অনুরোধ–‘যদি এর লেখা তোমরা দয়া করে একটু স্থান দাও তোমাদের পত্রিকায়।’ ঠিক উদীয়মান নয়, উদয়উন্মুখ দেবকী বোস বিনয়গলিত ভঙ্গিতে বসল কল্লোলের তক্তপোশে। দীনেশরঞ্জন হয়ত বুঝলেন, এর স্থান এই তক্তপোশে নয়, অন্য মঞ্চে। দমদমে তখন ধীরেন গাঙ্গুলিরা ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিলম কোম্পানি চালাচ্ছে, সেইখানে যাতায়াত ছিল দীনেশরঞ্জনের। দেবকী বোসকে সেখানে নিয়ে গেলেন দীনেশরঞ্জন। দেবকী বোস দেখতে পেল তার সাফল্যের সম্ভবনা। সে আর ফিরল না। বলাই দেবশর্মার পরিচয়পত্র প্রত্নতত্ত্বে লীন হয়ে গেল!
সিনেমায় ফল পেলে সাহিত্যফলের জন্যে বুঝি কেউ আর লালায়িত হয় না। মদের স্বাদ পেলে মধুর সন্ধানে কে আর কমলবনে বিচরণ করে? এককালে দারিদ্র্যপীড়িত লেখকের দল ভাগ্যদেবতার কাছে এই প্রার্থনাই করেছিল, জমিদারি-তেজারতি চাই না, শুধু অভাবের ঊর্ধ্বে থাকতে দাও, এই ক্লেশক্লেদময় কায়ধারণের ঊর্ধ্বে। দাও শুধু ভদ্র পরিবেশে পরিমিত উপার্জন, যাতে স্বচ্ছন্দ-স্বাধীন মনে পরিপূর্ণ ভাবে সাহিত্যে আত্মনিয়োগ করতে পারি। সাহিত্যই মুখ্য আর সব গৌণ। সাহিত্যই জীবনের নিশ্বাসবায়ু।
গল্পে নাকের বদলে নরুন দিয়েছিল। ভাগ্যদেবতা সাহিত্যের বদলে সিনেমা দিলেন।
২৩. আজি দোল পূর্ণিমাতে
লিখছি, চোখের সামনে কম্পমান কুয়াসার মত কি-একটা এসে দাঁড়াল ভাসতে ভাসতে। আস্তে-আস্তে সে শূন্যাকার কুয়াসা রেখায়িত হয়ে উঠল। অস্পষ্ট এক মানুষের মূর্তি ধারণ করলে। প্রথমে ছায়াময়, পরে শরীরী হয়ে উঠল।
অপরূপ সুন্দর এক যুবকের মূর্তি। যুবক, না, তাকে কিশোর বলব? ধোপদস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এসেছে, পায়ে ঠনঠনের চটি। মাথায় একরাশ এলোমেলো চুল। সেই শিথিল খলিত কেশদামে তার গৌর মুখোনি মনোহর হয়েছে। ঠোঁটে বৈরাগ্যনির্মল হাসি, চোখে অপরিপূর্ণতার ঔদাস্ত। হাতে কতগুলি ছিন্ন পাণ্ডুলিপি।
কে তুমি?
চিনতে পাচ্ছ না? ম্লানমুদুরেখায় হাসল আগন্তুক: আমি সুকুমার।
কোন সুকুমার?
সুকুমার সরকার।
চিনতে পারলাম। কল্লোলের দলের নবীনতম অভ্যাগত।
হাতে ও কী! কবিতা? প্রশ্ন করলাম সকৌতূহলে।
পৃথিবীতে যখন এসেছি, কবিতার জন্যেই তো এসেছি। কবিতায়ই তো পৃথিবীর প্রাণ, মানুষের মুক্তি। স্বর্গের অমৃতের চেয়েও পৃথিবীর কবিতা অমৃততর।
কিসের কবিতা? প্রেমের?
প্রেম ছাড়া আবার কবিতা হয় নাকি? তোমাদের এ সময়ে রুটি নিয়ে ঢের রোমাণ্টিসিজম চলেছে—কিন্তু যাই বলো, সব খিদেই মেটে, প্রেমের ক্ষুধাই অতৃপ্য। লাখো লাখো যুগ হিয়ে হিয় রাখনু–এ তো কম করে বলা। শুনবে একটা কবিতা? সময় আছে?
তার পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল সুকুমার :
সে হাসির আড়ালে রাখিব দুই সারি খেত মুক্তামালা,
রাঙা-রাঙা ক্ষীণ মণি-কণা পাশে-পাশে অঙ্কিব নিরালা!
শ্রাবণের উড়ন্ত জলদে রচি এলো-কেশ নিরুপম,
সিঁথি দেব তমালের বনে সরিতের শীর্ণ ধারা সম!
ললাট সে লাবণ্যবারিধি, সিঁদুর প্রদীপ তার বুকে
অলকের কালিমা-সন্ধ্যায় ভাসাইব তৃপ্তিভরা সুখে!
বাহু হবে বসন্ত উৎসবে লীলায়িত বেতসের মত,
স্পর্শনের শিহর-কণ্টকে দেবে মধুদংশ অবিরত!
চম্পকের কুঁড়ি এনে এনে সৃষ্টি করি সুন্দর আঙুল,
শীর্ষদেশে দেব তাহাদের ছোট-ঘোট বাঁকা চন্দ্রফুল!
সুমুখী কুসুমের বুকে যে সুবর্ণ যৌবনের আশ
নিঙাড়িয়া তার সর্বরস এঁকে দেব বক্ষের বিলাস!
পরে অর্থ হৃৎপিণ্ড মোর নিজ হাতে ছিন্ন কবি নিয়া
দেহে তব আনিব নিশ্বাস প্রেমমন্ত্রে প্রাণ প্রতিষ্টিয়া!