তাই ভাবি যখন যাব তখন ভয় কেন? এখনও শিরায় জোয়ার ভাটা চলছে, স্নায়ুতে সাড়া আছে, তবে চোখ বুজে মাথা গুজে পড়ব কেন? যেমন অজান্তে এসেছিলাম তেমনি অজান্তে চলে যাব—হয়ত শুধু একটু ব্যথা একটু অন্ধকার একটু যন্ত্রণা। তা হোক। এখন এই নীলাভ নিথর রাত্রি, এই কোমল জ্যোৎস্না, তালস পৃথিবীর গুঞ্জন—সমস্ত প্রাণ দিয়ে পান করি না কেন—এই বাতাসের ক্ষীণ শীতল ছোঁয়া—এই সব।
এমনি সুন্দর শরতের প্রভাতে নিষ্কলঙ্ক শিশিরের মত না একদিন এসেছিলাম অপরূপ এই নিখিলে। কত বিস্ময় সে সাজিয়েছে, কত আয়োজন কত প্ৰাচুৰ্য্য। কত আনন্দই না দেখলাম। হ্যাঁ, দুঃখও দেখেছি বটে, দেখেছি বটে কদৰ্য। মার চোখের জল দেখেছি, গলিত কুই দেখেছি, দেখেছি লোভের নিষ্ঠুরতা, অপমানিতের ভীরুতা, লালসার জন্য বীভৎসতা, নারীর ব্যভিচার, মানুষের হিংসা, কদাকার অহঙ্কার, উন্মাদ, বিকলা, রুগ্ন-গলিত শব। তবু তবু তুলনা হয় না বুঝি!
এই যে জাপানের এতগুলো প্রাণ নিয়ে একটা অন্ধ শক্তি নির্মম খেলাটা খেললে—এ দেখেও আবার যখন শান্ত সন্ধ্যায় ঝাপসা নদীর ওপর দিয়ে মন্থর না-খানি যেতে দেখি স্বপ্নের মত পাল তুলে, যখন দেখি পথের কোল পর্যন্ত তরুণ নির্ভয় ঘাসের মঞ্জি এগিয়ে এসেছে, দুপুরের। অলস প্রহরে সামনের মাঠটুকুতে শালিকের চলাফেরা দেখি, তখন বিশ্বাস হয় না আমার মত না নিয়ে আমায় এই দুঃখভরা জগতে আনা তার নিষ্ঠুরতা হয়েছে।
একটা ছোট্ট, অতি ছোট্ট পোকা—একটা পাইকা অক্ষরের চেয়ে বড় হবে না—আমার বইয়ের পাতার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে পাখা দুটি ছড়িয়ে–কি আশ্চর্য নয়? এইবারের পৃথিৰীতে এই জীবনের পরিচিতদের মধ্যে ও-ও একজন। ওকেও যেতে হবে। আমাকেও।
কিন্তু এমন অপরূপ জীবন কেনই বা সে দেয়, কেনই বা কেড়ে নেয় কিছু বুঝতে পারি না—শুধু এইটুকুই বিরাট সংশয় রয়ে গেল। যদি এমন নিঃশেষ করে নিশ্চিহ্ন করে মূছেই দেবে তবে এমন অপরূপ করে বিস্ময়েরও অতীত করে দিলে কেন? কেন কে বলতে পারে? এত আশা এত বিশ্বাস এত প্রেম এত সৌন্দৰ্য্য—আমার জগতের চিহ্ন পৰ্যন্ত থাকবে না—কোনো অনাগত কালের তৃণের রস জোগাবে হয়ত আমার দেহের মাটি—অনাগত মানুষের নীলাকাশতলে তাদের রৌদ্রে তাদের। বাতাসে তাদের ঝড়ে তাদের বর্ষায় থাকব ধূলা হয়ে বাষ্প হয়ে। প্ৰীতি-বিনিময় তোর সাথে আমার, দুদিনের জীবনবুদের সঙ্গে দুদিনের জীবুদ্বুদের। তবু জয়তু জীবন জয়, জয় জয় সৃষ্টি–
কুস্তি করে সারা গায়ে মাথায় ধুলো মাটি মাখা-কাপড়ের খুঁটটা শুধু গায়ের উপর মেলে দেওয়া-সকালবেলা ভবানীপুরের নির্জন রাস্তা ধরে বাঁশের আড়বাঁশি বাজিয়ে ঘুরে বেড়াত কে একজন। কোন নিপুণ ভাস্কর্যের প্রতিমূতি তার শরীর, সবল, সুঠাম, সুতনু। বললিতা ও লাবণ্যের আশ্চর্য সমন্বয়। সে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের যে একজন শ্রেষ্ঠ ভাস্কর হবে, যৌবনের প্রারম্ভেই তার নিজের দেহে তার নির্ভুল আভাস এনেছে। ব্যায়ামে বলসাধনে নিজের দেহকে নির্মাণ করেছে গঠনগৌরবদৃপ্ত, সর্বসঙ্গত করে।
ইস্কুলে যে-বছর প্রেমেনকে গিয়ে ধরি সেই বছরই দেবীপ্রসাদ বেরিয়ে গেছে চৌকাট ডিঙিয়ে। কিন্তু ভবানীপুরের রাস্তায় ধরতে তাকে দেরি হল না। শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিট ও চৌরঙ্গীর মোড়ের জায়গাটাতে তখন একটা একজিবিশন হচ্ছে। জায়গাটার হারানো নাম পোড়াবাজার। নামের জন্যেই একজিবিশনটা শেষ পর্যন্ত পুড়ে গিয়েছিল কিনা কে বলবে। একদিন সেই একজিবিশনে দেবীপ্রসাদের সঙ্গে দেখা—একটি সুবেশ সুন্দর ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা কইছে। ভদ্রলোক চলে গেলে জিগগেস করলাম, কে ইনি? দেবীপ্রসাদ বললে, মণীন্দ্রলাল বসু।
এই সেই? ভিড়ের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম। কোথাও দেখা পেলাম না। এর কত বছর পর মণীন্দ্রলালের সঙ্গে দেখা। কল্লোল যখন খুব জমজমাট তখন তিনি ইউরোপে। তারপর কল্লোল বার হবার বছর পাঁচেক পরে বিচিত্রায় যখন সাব-এডিটরি করি তখন ভিয়েনা থেকে লেখা তাঁর ভ্রমণকাহিনীর প্রুফ দেখেছি।
আভ্যুদয়িক উঠে গেল। তার সব চেয়ে বড় কারণ হাতের কাছে কল্লোল পেয়ে গেলাম। যা চেয়েছিলাম হয়তো, তৈরি কাগজ আর জমকালো আড্ডা। সে সব কথা পরে আসছে।
একদিন দুজনে, আমি আর প্রেমেন, সকালবেলা হরিশ মুখার্জি রোড ধরে যাচ্ছি, দেখি কয়েক রাশি সামনে গোকুল নাগ যাচ্ছে, সঙ্গে দুইজন ভদ্রলোক। লম্বা চুল ও হাতে লাঠি গোকুলকে চিনতে দেরি হয় না কখনো।
বললাম, ঐ গোকুল নাগ। ডাকি।
না, না, দরকার নেই। প্ৰেমেন বারণ করতে লাগল।
কে ধার ধারে ভদ্রতার! গোকুলবাবু গোকুলবাবু বলে রাস্তার মাঝেই উচ্চস্বরে ডেকে উঠলাম। ফিরল গোকুল আর তার দুই সঙ্গী।
প্রেমেনের তখন দুটি গল্প বেরিয়ে গেছে প্রবাসীতে—শুধু কেরাণী আর গোপনচারিণী। আর, সেই দুটি গল্প বাংলা সাহিত্যের গুমোটে সজীব বসন্তের হাওয়া এনে দিয়েছে। এক গল্পেই প্রেমেনকে তখন একবাক্যে চিনে ফেলার মত।
পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় হল। কিন্তু গোকুলের সঙ্গে ঐ দুজন সুচারুদর্শন ভদ্রলোক কে?
একজন ধীরাজ ভট্টাচার্য।
আরেকজন?
ইনি শৈলজা মুখোপাধ্যায়। সানন্দবিস্ময়ে তাকালাম ভদ্রলোকের দিকে। বাংলা সাহিত্যে ইনিই সেই কয়লকুঠির আবিষ্কর্তা? নিঃস্ব রিক্ত বঞ্চিত জনতার প্রথম প্রতিনিধি? বাংলা সাহিত্যে যিনি নতুন বস্তু নতুন ভাষা নতুন ভঙ্গি এনেছেন? হাতির দাঁতের মিনারচূড়া ছেড়ে যিনি প্রথম নেমে এসেছেন ধুলিস্নান মৃত্তিকার সমতলে?