কল্লোলের এ নব পর্যায়টি আরো মধুর হয়ে উঠল। দুয়ার অনুক্ষণ খোলা আছে, হে তরুণ, জয়হীন যৌবনের পূজারী, নবজীবনের বার্তাবহ, এখানে তোমাদের অনন্ত নিমন্ত্রণ। বর্ষে-বর্ষে যুগে-যুগে আসবে এমনি এই যৌবনের ঢেউ। ধরন-ধারণ-করণ-কারণ-না-জানা শাসন-বারণ-না-মানা নিঃসম্বলের দল। স্বপ্নের নিশান নিয়ে সত্যের চারণেরা। কল্লোল চিরযুবা। চিরযুবা বলেই চিরজীবী।
সত্যেন্দ্র দাস কোথায় সরে পড়ল, থেকে গেল আর চারজন, পাঁচুগোপাল, প্রণব, ফণী আর সুনীল—বন্ধু চতুষ্টয়। একটি সংযুক্ত প্রচেষ্টা ও একটি প্রতিপ্রেরিত একপ্রণতা। যেন বিরাট একটা বন্যার জল কোথায় গিয়ে নিভৃতে একটি স্তব্ধ-শীতল জলাশয় রচনা করেছে। কল্লোল উঠে গেলে আড্ডার খোঁজে চলে এসেছি এই বন্ধু-চতুষ্টয়ের আখড়ায়। পেয়েছি সেই হৃদয়ের উষ্ণতা, সেই নিবিড় ঐক্যবোধ। মনে হয়নি উঠে গেছে কল্লোল।
এ সময়ে নবাগত বন্ধুর সমাগমে মহাকাল নামে এক পত্রিকার আবির্ভাব হয়। শনিবারের চিঠির প্রত্যুক্তি। শনিবারের চিঠি যেমন বাংলাসাহিত্যের শ্রদ্ধেয়দের গাল দিচ্ছে—যেমন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী, দীনেশচন্দ্র ও নরেশচন্দ্র—তেমনি আরো কজন শ্রদ্ধাভাজনদের—যাদের প্রতি শনিবারের চিঠির মমতা আছে-তাদেরকে অপদস্থ করা। মহাকালের সঙ্গে আমি, বুদ্ধদেব ও বিষ্ণু সংশ্লিষ্ট ছিলাম। মহাকাল অনন্তকাল ধরে রক্তের অক্ষরে মানুষের জীবনের ইতিহাস লেখে, কিন্তু–এ মহাকাল যে কিছুকাল পরেই নিজের ইতিহাসটুকু নিয়ে কালের কালিমায় বিলুপ্ত হয়ে গেল এ একটা মহাশান্তি। বিবেচনা করে দেখলাম, যে সৃষ্টিকর্তা সে শুধু রচনাই করে সমালোচনা করেনা। যিনি আকাশ ভরে এত তারার দীপ জ্বালিয়েছেন তিনি জ্যোতিষশাস্ত্র লেখেন না। মল্লিনাথের চেয়ে কালিদাস অতুলনীয়রূপে বড়। সৃষ্টিতে যে অপটু সেই পরের উচ্ছিষ্ট ঘাটে। নিজের পূর্ণতার দিকে না গিয়ে সে যায় পরের ছিদ্রান্বেষণের দিকে। লেখক না হয়ে অবশেষে সমালোচক হয়।
নিন্দা করছে তো করুক। নিন্দার উত্তর কি নিন্দা? নিন্দার উত্তর, তন্নিষ্ঠের মত নিজের কাজ করে যাওয়া, নিজের ধর্মপথে দৃঢ়ত থাকা। স্বভাবচ্যুতি না ঘটানো। আত্মস্বরূপে অবস্থিতি করা। এক কথায় চুপ করে যাওয়া। অফুরন্ত লেখা। ধ্যানবৃক্ষের ফল এই স্তব্ধতা। কর্মবৃক্ষের ফল এই সৃষ্টি। আরো সংক্ষেপে, ধৈর্য ধরা। ধৈর্যই সব চেয়ে বড় প্রার্থনা।
তাছাড়া, এমনিতেও মহাকাল চলতনা। তার কারণ অন্য কিছু নয়, এ ধরনের কাগজ চালাতে যে কূটনীতি দরকার তা তার জানা ছিলনা। হেয়-র সঙ্গে উপাদেয়কে মিশিয়ে দেওয়া, লঘুর সঙ্গে গম্ভীর, খিস্তি-খেউড়ের সঙ্গে বৈরাগ্যশতক বা বেদান্তদর্শন। শনিবারের চিঠি এ বিষয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিমান। এদিকে মণিমুক্তার আবর্জনা, অন্যদিকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, মোহিতলাল মজুমদার, ঘতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, রঙীন হালদার ইত্যাদির প্রবন্ধ। অকুলীনকে আভিজাত্যের মুখোস পরানো। এবং, এতদূর পর্যন্ত যে, মোহিতলাল শিবস্তব করতে বসলেন। কথাই আছে, শিবব ভূত্বা শিবং যজেৎ। শনিবারের চিঠিকে উদ্দেশ করে লিখলেন মোহিতলাল।
শিব’ নাম জপ করি’ কালরাত্রি পার হয়ে যাও–
হে পুরুষ! দিশাহীন তরণীর তুমি কর্ণধার!
নীর-প্রান্তে প্রেতচ্ছায়া, তীরভূমি বিকট আঁধার–
ধ্বংস দেশ–মহামারী!–এ শ্বশানে কারে ডাক দাও?
কাণ্ডারী বলিয়া কারে তর-ঘাটে মিনতি জানাও?
সব মরা!–শকুনি গৃধিনী হের ঘেরিয়া সবার
প্রাণহীন বীর-বপু, ঊর্দ্ধস্বরে করিছে চীৎকার!
কেহ নাই!–তরী ‘পরে তুমি একা উঠিয়া দাঁড়াও।
ছলভরা কলহাস্যে জলতলে ফুঁসিছে ফেনিল
ঈৰ্যার অজস্র ফণা, অৰ্দ্ধমগ্ন শবের দশনে
বিকাশে বিদ্রুপ-ভঙ্গি, কুৎসা-ঘোর কুহেলি ঘনায়–
তবু পার হতে হবে, বাঁচাইতে হবে আপনায়!
নগ্ন বক্ষে, পাল তুলি’ একমাত্র উত্তরী-বসনে,
ধর হাল—বদ্ধ করি’ করাঙ্গুলি, আড়ষ্ট আনীল!
আদিরসসিক্ত আধুনিক কীর্তনেও এমনি ভাবে রাধা-কৃষ্ণের নাম ঢুকিয়ে দেবার চতুরতা দেখেছি।
আরো দুজন লেখক চকিততড়িতের মত এসে চলে গেল—কল্লোলের বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় আর ধূপছায়ার অরিন্দম বসু। বাসুদেব কল্লোলের বহু আড্ডা-পিকনিকে এসেছে, হেসে গেছে অনেক উচ্চ হাসি—বিচিত্রায়ও তার লেখায় জের চলেছিল ছিল। তারপর কোথায় চলে গেল তার ঠিকানা নেই। অরিন্দম বেপাত্তা।
এসেছিল অখিল নিয়োগী আর মন্মথ রায়। মন্মথকে যদিও সব সময়ে মনের মত করে পাওয়া যেত না কাছাকাছি, অখিলের ঘরের দরজায় খিল ছিল না। আমাদের বইয়ের তো আবার একজন আর্টিস্ট চাই—অখিলই আমাদের সেই চিত্তরঞ্জী চিত্রকর।
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশি ও পরিমল গোস্বামীও কল্লোলে লিখেছেন। বিভূতিবাবু প্রায় নিয়মিত লেখকের মধ্যে। তাঁর অনেকগুলি গল্প কল্লোলে বেরিয়েছে, কিন্তু তিনি নিজে কোনোদিন কল্লোলে আসেননি। যিনি হাসির গল্প লেখেন তিনি সকল দলেই হাসির খোরাক পান এবং কাজেকাজেই তিনি সকল দলের বাইরে। বা, তিনি সকল দলের সমান প্রিয়।
শিবরাম তো হাসির গল্প লেখে, তবে তাকে কল্লোলের দলে টানি কেন? কারণ কল্লোলের সমসময়ে শিবরাম বিপ্লবপ্রধান কবিতা লিখত। যার কবিতার বইর নাম মানুষ আর চুম্বন সে তো সবিশেষ আধুনিক। বই দুখানি থেকে দুটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :