গানটি দুয়ার নাম দিয়ে কল্লোলে ছাপা হয়েছিল। এ দুয়ায় প্রকাশ-প্রারম্ভের প্রতীক, চিরকালের অনাগতের আমন্ত্রণ। সেই অর্থে ও গানটির প্রযুক্ততা কল্লোলে অত্যন্ত স্পষ্ট।
হে দুয়ার, তুমি আছো মুক্ত অনুক্ষণ
রুদ্ধ শুধু অন্ধের নয়ন।
অন্তরে কী আছে তাহা বেঝেনা সে তাই
প্রবেশিতে সংশয় সদাই।।
হে দুয়ার, নিত্য জাগে রাত্রি দিনমান
সুগম্ভীর তোমার আহ্বান।
সূর্যের উদয় মাঝে খেলে আপনারে
তারকায় খোলো অন্ধকারে।।
হে দুয়ার, বীজ হতে অঙ্কুরের দলে
খোলো পথ, ফুল হতে ফলে।
যুগ হতে যুগান্তর করো অবারিত
মৃত্যু হতে পরম অমৃত।।
হে দুয়ার, জীবলোক তোরণে তোরণে
করে যাত্রা মরনে মরণে।
মুক্তি সাধনার পথে তোমার ইঙ্গিতে
“মা ভৈঃ” বাজে নৈরাশ্যনিশীথে।
অমিয়বাবুর ভাই অজিত চক্রবর্তীর নাম সাহিত্যের দৈনিক বাজারে প্রচলিত নয়। কেননা সে তো সাহিত্য রচনা করেনি, সে সাহিত্য ভজনা করেছে। ভক্ত কি ভজনীয়ের চেয়ে কম? রসস্রষ্টার দাম কি যদি রসজ্ঞ না থাকে। চারদিকেই যদি অরসিক-বেসিকের দল, তবে তো সমস্ত সৃষ্টি রসাতলে। অজিত চক্রবর্তী ছিল রসোপভোগের দলে, তার কাজ ছিল তার বোধের দীপ্তি দিয়ে লেখকদের বোধিকে উত্তেজিত করা। ট্রামে-সে রাস্তা-ঘাটে যেখানেই দেখা হোক, কার কী কবিতা ভালো লেগেছে তাই মুখস্ত বলা। অনেক দিন দেখা না হলে বাড়িতে বয়ে এসে অন্তত প্রশংসনীয় অংশটুকুকে চিহ্নিত করে যাওয়া। যার সৃষ্টিকে সুন্দর বলে অনুভব করলাম সেই আনন্দ সৃষ্টিকর্তাকে পৌছে না দিলে আস্বাদনের পূর্ণতা কই?
সর্বতোদীপ্ত যৌবনের প্রতি ছিল অজিত। সে যে অকালে মরে গেল তাতেও তার রসবোধের গভীরতা উহ্য ছিল। জীর্ণ বসন ছাড়তে যদি ভয় নেই তবে মৃত্যুতে বা কী ভয়? তার নিঃশব্দ মুখে এই রসাস্বাদের প্রসন্নতাটি চিরকালের জন্যে লেখা হয়ে আছে।
একদিন এক হালকা দুপুর কল্লোল-আপিসের ঠিকানায় লম্বাটে খামে একটা চিঠি পেলাম। কবিতায় লেখা-চিঠি-১০৯ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট থেকে লিখেছে কে এক শ্যামল রায়। কবিতাটি উদ্ধৃত করতে সংকোচ হচ্ছে, কবির তরফ থেকে নয়, আমার নিজের তরফ থেকে। কিন্তু যখন ভাবি শ্যামল রায় বিষ্ণু দে এবং এই চিঠির সূত্র ধরেই তার কল্লোলে আবির্ভাব, তখন চিঠিটির নিশ্চয়ই কিছু ঐতিহাসিক মূল্য আছে। তাই তুলে দিচ্ছি :
হৃদয়ের মাঝে আছে যে গোপন বেদে,
অদ্ভুত তার বিচিত্র কিবা ভাষা,
অপরূপ তার ক্ষণিকের ভালোবাসা
ঘোরে সে কেবল খেয়ালিয়া হেসে কেঁদে।
ভাষার বাঁধন রেখে দেছে তারে বেঁধে
ফোটেনিক তার অতীত স্মৃতি ও আশা,
জোটেনিক তার কবিদের স্নেহ-হাসা—
বেদে যে ডুবেছে মনুনিষিদ্ধ ক্লেদে।
তুমি দিলে তার মুমুখমাঝে ভাষা
হে নবস্রষ্টা! দিলে জীবনের আশা।
বনজ্যোৎস্নার আলোতে ছেয়েছে মন,
মৈত্রেয়ী মোরে মিত্র করেছে তার,
বাতাসী খুলিছে উদাস হিয়ার দ্বার–
হৃদয়বেদিয়া ঘুরিছে—এই জীবন?
স্বপ্নভরা দুটি সম্মিত চোখ, সুমিতমৃদু কথা আর সরলসুস্থ হাসি–এই তখন বিষ্ণু দে। এন্তার বই আর দেদার সিগারেট—দুইই অজস্র পড়তে আর পোড়াতে দেয় বন্ধুদের। বেশবাসে সাদাসিধে হয়েও বিশেষভাবে পরিচ্ছন্ন, ব্যবহারে একটু নির্লিপ্ত হয়েও সৌজন্যসুন্দর। কাছে গেলে সহজে চলে আসতে ইচ্ছে করেনা। বুদ্ধির ঝলস বা বিদ্যের জৌলুসের বাইরেও এমন একটি নিভৃত হৃদ্যতা আছে যা মনকে আকর্ষণ করে, ভিড় সরিয়ে মনের অন্দরে বসিয়ে রাখে। যেটুকু তার স্থান ও যেটুকু তার সংস্থান তারই মধ্যে তার সৌন্দর্যের অধিষ্ঠান দেখেছি। ঠিক গল্প নয়, কেচ্ছ। শুনতে ও বলতে খুব ভালবাসে বিষ্ণু। এবং সে সব কাহিনীর মধ্যে যেটুকুতে দ্বেষমুক্ত শ্লেষ আছে সেটুকুই আহরণ ও বিতরণ করে। স্মৃতিশক্তি প্রখর, তাই মজাদার কাহিনী সঞ্চয় তার অফুরন্ত। অল্প কথায় অনেক অর্থের সূচনা করতে জানে বলে বিষ্ণুর রচনায় নিরু আবেগ, প্রোজ্জ্বল কাঠিন্য।
প্রগতিতে তখন পুরাণের পুনর্জন্ম লেখা হচ্ছে—হালের সমাজ ও সভ্যতার পরিবেশে রামায়ণের পুনর্লেখন। প্রভু গুহঠাকুরতাই সে লেখার উদ্বোধন করেছেন। তারই অনুসরণে বিষ্ণু কল্লোলে পৌরাণিক প্রশাখা লিখলে-ভরতকে নিয়ে। প্রভু গুহ-ঠাকুরতা ঢাকার দলের মুকুটমণি–ব্যক্তিত্বে-স্বাতন্ত্র্যে শোভনমোহন। ওঁর কাছ থেকে সাহিত্যবিষয়ে পাঠ নেওয়া, বই পড়তে চাওয়া বা সিগারেট খেতে পাওয়া প্রায় একটা সম্মাননার জিনিস ছিল। আমার তিরিশ-গিরিশের বাসায় যখন উনি প্রথম আসেন, তখন মনে হয়েছিল লক্ষ্মীছাড়াদের দলে এ কোন লক্ষ্মীমন্ত রাজপুত্র। কিন্তু যিনি লক্ষ্মীছাড়াদের গুরু তাঁকে সুলক্ষণাক্রান্ত মনে করার কোনো কারণ ছিলনা। নোঙর-ছেঁড়া ভাঙা নৌকোয় তিনি অপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
আমরা নোঙর-ছেঁড়া ভাঙা তরী ভেসেছি কেবল।
আমরা এবার খুলে দেখি অকূলেতে কূল মেলে কি,
দ্বীপ আছে কি ভবসাগরে–
যদি সুখ না জোটে দেখব ডুবে কোথায় রসাতল।।
ধূপছায়া বেরোয় এ সময়। আধুনিক সাহিত্যেরই পতাকাবাহী পত্রিকা। সম্পাদক ডাক্তার রেণুভূষণ গঙ্গোপাধ্যায় স্কুলে আমার আর প্রেমেনের সহপাঠী ছিল। তাই আমাদের দলে টানল সহজেই। সেই টানে আমরা ও-দল থেকে নতুন কয়েকজন লেখককে কল্লোলে নিয়ে এলাম। পাঁচুগোপাল মুখোপাধ্যায় আগেই এসেছিল, এবার এল সত্যেন্দ্র দাস, প্রণব রায়, ফণীন্দ্র পাল আর সুনীল ধর। ভবের পদ্মপত্রে আরো কটি চঞ্চল জলবিন্দু। নবীনের দীপ্তার্করাগে ঝলমল।