তুমি কলকাতাতেই একটা লেকচারারী জোগাড় করে থেকে যাও। মুনসেফী বড় বিদঘুটে। তোমাদের কি খুব টাকার টানাটানি?….
বন্ধু,
অনেকদিন পর তুমি আমাকে একখানা চিঠির মত চিঠি লিখলে। চিঠির জবাব আমি প্রাপ্তিতে লিখতে ভালোবাসি, দেরি করলে নিতে প্রবৃত্তি হয়না, তা ঘুলিয়ে যায়।…
দশ বছর আমি সমাজ-ঘাড়া, কদাচ আমার আপনার লোকেদের সঙ্গে দেখা হয়। ক্কচিৎ তাদের উপর আমি নির্ভর করেছি অন্নবস্ত্রের জন্যে বা সাংসারিক সুবিধার জন্যে। এমনি করে আমি একটা Semi-সন্ন্যাসী হয়ে পড়েছি। আমার পক্ষে বিয়ে করা হচ্ছে সমাজের সঙ্গে পুরোদস্তুর জড়িয়ে পড়া—শশুর শাশুড়ী শালা শালী ইত্যাদির উৎপাত সওয়া। তাহলে চিরকাল এই চাকরীতে বাধা থাকতে হয়। তাহলে ইউরোপে পালিয়ে বসবাস করা চলেনা। একলা মানুষের অনেক সুবিধা। He can travel from China to Peru.
মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে বটে বিয়ে করে সংসারী হই—একটি জমিদায়ী কিনি, বাগানবাড়ীতে থাকি, নিজের ইস্কুলে পড়াই, নিজের হাতে বীজ বুনি ও ফসল কাটি। একটি কল্যাণী বধু, কয়েকটি সুন্দর স্বাস্থ্যবান ছেলেমেয়ে।
কিন্তু এর জন্যে অপেক্ষা করতে হয়। এস্বপ্ন একা আমার হলে চলবে না। আরেকজনের হওয়া চাই। সাহিত্য আমার কাছে প্রাণের মতো প্রিয়। কিন্তু ওর চেয়ে প্রিয় সুসমঞ্জস প্রেম। ও-জিনিষ পেলে আমি হয়তো সাহিত্য ছেড়ে দিতে পারি। জীবনের মধ্যাহ্ন কালটা purely উপলব্ধি করতে চাই। তারপরে সন্ধ্যা এলে জীবনের রূপকথা বলার সময় হবে।…
I feel like a child very often, আমি খানিক কেঁচেছি। যুবক হতে আমার কিছু বিলম্ব হবে, কৈশোরটা ভালো করে শেষ করে নিই। আমার বিয়ের বয়স হয়নি।
তোমার চাকরীর জন্য চিন্তিত হয়েছি। তুমি খুব অল্প বেতনে কাজ করতে রাজী হও তো ঢেঙ্কানালের রাজাকে লিখতে পারি। ঢেঙ্কানালের জল-হাওয়া ভালো। কত কম মাইনেতে কাজ করতে পারো, লিখো। ঢেঙ্কানালে চার পাচজন মানুষের একটি পরিবার ৪০/৪৫ টাকায় বেশ চলে। ভাবলে বলছিনে যে তুমি ৫০ টাকার চাকরিতে রাজি হও। Say, 100/.?…ইতি।
তোমার অন্নদা।
অন্নদাশঙ্কর তেমন একজন বিরল সাহিত্যিক যার সান্নিধ্যে গিয়ে বসলে আধ্যাত্মিকতার একটি সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। (তেমন আরেকজনকে দেখেছি। সে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।) একটি মৌন মহত্ব যে তার চিন্তায় তা যেন স্পষ্ট স্পর্শ করি। কোনো কথা না বলে তার কাছে চুপ করে বসে-থাকাটিও অনেক কথা-ভরা। আত্মার সঙ্গে আত্মার যখন কথা হয় তখনই মহৎ আর্ট জন্ম নেয়। অন্নদাশঙ্কর সেই মহৎ আর্টের অম্বেষক। সাহিত্যের আদর্শ তার এত উঁচু, যা তার আয়ত্ত, অধিকৃত, তাতে সে আপ্তকাম নয়। জীবনে যে স্বস্থ ও শান্ত হতে পারে, কিনে সে সৃজনে সে অপরিতৃপ্ত। এমনিতে সহজ গৃহস্থ মানুষ, কিন্তু আসলে সে বন্দী প্রমিথিউস।
স্বচ্ছ সরল কথা, স্নিগ্ধ মুক্ত হাসি-চিত্তনৈল্যের দুটি অপরূপ চিহ্ন। স্টাইল বা লিখনরীতিই যদি মানুষ হয় তবে অন্নদাশঙ্করকে বুঝতে কারু ভুল হবেনা। মৌনের আবেগ নিষ্ঠার কাঠিন্য আর বৈরাগ্যের গাম্ভীর্য নিয়ে মাশরু। ভিড়ের মধ্যে থেকেও সে অসঙ্গ, অবিকৃত। আর যার বিকার নেই তার বিনাশও নেই। যাকে আমরা বাস্তব বলি তাই বিকার্য—শুধু কটি স্বপ্নই বুঝি অবিনাশী, মৃত্যুহীন। অন্নদাশঙ্কর সেই কটি স্বপ্নের চারু কারু।
ভালো লেখা লিখতে হবে। তার জন্যে চাই ভালো করে ভাবা, ভালো করে অনুভব করা আর ভালো করে প্রকাশ করা—তার মানে, একসঙ্গে মন প্রাণ আর আত্মার অধিকারী হওয়া। আশঙ্করের লেখা এই মন প্রাণ আর আত্মার মহামিলন।
অমিয় চক্রবর্তী কল্লোলে না লিখলেও কল্লোলযুগের মানুষ। এই অর্থে যে, তিনি তদানীন্তন তারুণ্যের সমর্থক ছিলেন। নিজেো অন্তরে সংক্রামিত করে নিয়েছিলেন সেই নতুনের বহ্নিকণা। শনিবারের চিঠির বিরুদ্ধে আমাদের হয়ে লড়েছিলেন বিচিত্রায়।
পুরোনো দিনের ফাইলে তাঁর একটা মাত্র চিঠি খুঁজে পাচ্ছি।
প্রিয়বরেষু, আপনার চিঠিখানি পেয়ে খুব ভালো লাগল। এবারকার যাত্ৰাপৰ্ব সুন্দর হোক—আপনাদের নুতন পত্রিকা ঐশ্বর্যে পূর্ণ হয়ে নিজেকে বিকশিত করুক এই কামনা করি। কল্লোলকে আপনি চৈতন্যময় মুক্তির বাণীতে মুখর করে তুলবেন—তার বীর্য অন্তরের নির্মলতারই পরিচয় হবে।
রবীন্দ্রনাথের এই ছোটো গানটি বোধ হয় কোথাও প্রকাশিত হয়নি। তিনি যাবার আগে বলে গিয়েছিলেন মহুয়ার কবিতা বাদে কোনো কিছু থাকলে তা আপনাকে পাঠাতে।
তাঁর ঠিকানা দিচ্ছি।…আপনি ঐ ঠিকানায় চিঠি লিখলে তিনি পাবেন—তবে পেতে দেরি হবে কেননা তিনি কোনো স্থানেই বেশি সময় থাকবেন না, কাজের ভিড়ও তাঁকে ঘিরে রাখবে। আপনার চিঠি এবং নূতন পত্রিকা পেলে তিনি বিশেষ আনন্দিত হবেন।
আমার একটা কবিতা পাঠালাম—এইটুকু অনুরোধমাত্র যেন ছাপা ভুল না হয়। এই ভয়বশত কোথাও কোনো কবিতা ছাপাতে ভরসা হয় না। প্রবাসীতেও ভুল করেছে—হয়তো এ বিষয়ে আমাদের কাগজপত্র অসাবধানী। কবিতা ছাপানোর কথা বলছি—কিন্তু বলা বাহুল্য এবারকার রচনা উপযুক্ত না ঠেকলে কখনোই ছাপাবেন না। পয়ে অন্য কিছু লিখে পাঠাতে চেষ্টা করব।
আমার একটা বক্তব্য ছিল। আপনার বেদে সম্বন্ধে কবির লেখা চিঠিখানি আপনি যদি সমগ্র উদ্ধৃত করে নূতন কল্লোলে ছাপান একটা বড় কাজ হবে। ঐ পত্রের মূল্য সমস্ত দেশের কাছে, আপনার লেখার সমালোচনা আছে কিন্তু তা ব্যক্তিগতের চেয়ে বেশি।