ভালো কথা, কল্লোলের দলের কেউ বা কারা কিছুক্ষণের জন ইউরোপে আসেননা কেন? Parisএ থাকবার খরচ মাসে ৬০/৬৫ (টাকা) যদি নিজের হাতে রান্না করে খান। একসঙ্গে তিন চার জন থাকলে আরো কম খরচ। গল্প ও প্রবন্ধ লিখে ওর অন্তত অর্ধেক রোজগার করা কি আপনার পক্ষে বা বুদ্ধদেব বসুর পক্ষে বা প্রবোধকুমার সান্যালের পক্ষে শক্ত? বাকী অর্ধেক কি আপনাদেরকে বন্ধুরা দেবে না? Parisএ বছর দুয়েক থাকা যে কত দিক থেকে কত দরকার তা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবেনা। বাঙালী ছাড়া সব জাতের সাহিত্যিক বাংলা ছাড়া সব ভাষায় ওখান থেকে কাগজ বার করে। কল্লোলের আপিস কলকাতা থেকে Parisএ তুলে আনেন না কেন? (Countee Cullen এখন Parisএ থাকেন-দেখা হলো।) আমার। নমস্কার। ইতি। আপনার–
শ্ৰীঅন্নদাশঙ্কর রায়
কাউণ্টি কালেন সেকালের নি*গ্রো কবি। তার দুটো লাইন এখনো মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে আছে।
Yet do I marvel at this curious thing :
To make a poet black and bid him sing!
২২. সাহিত্যের বদলে সিনেমা
জানা নেই শোনা নেই, অন্নদাশঙ্করের হঠাৎ একটা চিঠি পেলাম। বিলেত থেকে লেখা, যখন সে সেখানে ট্রেনিংএ। চিঠিতে আমার সম্বন্ধে যতো কিছু অতিশয়োক্তি ছিল—এহ বাহ্য–কি লিখেছে তার চেয়ে কে লিখেছে সেইটেই গণনীয়। পত্রের চেয়েও স্পর্শটাই বেশি স্বাদু, বেশি স্বাগত। অন্নদাশঙ্করের সেই হস্তলিপি জীবনের পত্রে জীবনদেবতার নতুনতরো স্বাক্ষর।
বিলেত থেকে এলে তার সঙ্গে মিলিত হলাম। তাকে দেখার প্রথম সেই দিনটি এখনো মনের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সে শুধু রৌদ্রের উজ্জলতা নয়, একটি অনির্বের তারুণ্যের উজ্জলতা। অন্নদাশঙ্করের তারুণ্য কল্লোলযুগের মর্মবাণী।
ক্রমে ক্রমে সেই পরিচয়ের কলি বন্ধুতার ফুলে বিকশিত হয়ে উঠল। লাগল তাতে অন্তরঙ্গতার সৌরভ। দুজনে শান্তিনিকেতনে গেলাম, রবীন্দ্রনাথের শরিধানে। অমিয় চক্রবর্তীর অতিথি হলাম। কটা দিন মুখস্বপ্নের মত কেটে গেল। মুখ যায় কিন্তু স্মৃতি যায়না।
অন্নদাশঙ্করের চিঠি :
বন্ধু,
আমি ভেবেছিলুম তোমার অসুখ করেছে, শারীরিক অসুখ। তাই বেশ একটু উদ্বিগ্ন ছিলুম। আজকের চিঠি পেয়ে বোঝা গেলো অসুখ করেছে বৈ কি, কিন্তু মানসিক। উদ্বেগটা বেশী হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু মানুষের সংস্কার অন্যরকম।…
সতী পূজার সময় এখানে এলে কেমন হয়? বিবেচনা করে লিখো। সাহিত্যিক জলবায়ুর অভাবে মারা যাচ্ছি। দ্বিজেন মজুমদার না থাকলে এতদিনে ভূত হয়ে যেতুম।
কাল রাত্রি ২টার সময় ডিনার ও ডান্স থেকে ফিরি। নাচতে জানিনে, বসে বসে পর্য্যবেক্ষণ করছিলুম কে কী পরেছে, কত রং মেখেছে, ক’বার চোখ নাচায় ও কানের দুল দোলা, কেমন করে nervous আমি হাসে-যেন হি উঠেছে। ইত্যাদি। ইংরেজ ও ইঙ্গবঙ্গদের ভিড়ে আমার এত খারাপ লাগছিল তবু study করাব লোত দমন করতে পারছিলুমনা।
পরশু রাতে ১টা অবধি হয়েছিল fancy dress ball. আমি সেজেছিলুম সন্ন্যাসী। সকলে তারিফ করেছিল।
এমনি করে দিন কাটছে। কবে কে নিমন্ত্রণ করলে, কে করলে না, কে ইচ্ছে করে অপমান করলে, কে মান রাখলেনা—এই সব নিয়ে মন কষাকষি চলেছে ক্লাবের মেম্বরদের সঙ্গে। মুস্কিল হয়েছে এই যে দ্বিজেন ও আমি হাফগেরস্থ। আমরা যদি একেবারে পার্টিতে যাওয়া বন্ধ করে দিতুম ও সানন্দে একঘরে হতুম, তবে এসব pin prick থেকে বাঁচা যেতো। কিন্তু আমরা dinner jacket পরে খেতে যাই অথচ বাঙালী মেয়েদের বিজাতীয়তা দেখে মর্মাহত হই। আমরা ইংরেজী পোষাকে চলি ফিরি, অথচ কোনো বাঙালী তার স্ত্রীকে dearie ডাকছে শুনলে চটে যাই। আমাদের চেয়ে যারা আরেক ডিগ্রী সাহেবিয়ানাগ্রন্ত তাদের সম্বন্ধে আমাদের যে আক্রোশ আমাদের ওপরে ডেপুটীবাবুদের বোধ হয় সেই আক্রোশ। কিন্তু জাতিভেদের দরুণ ডেপুটী-উকীল-জমিদার ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের পরিচয় পৰ্যন্ত হয়নি।
মোটের উপর বড় বিশ্রী লাগছে। টেনিসটা মোজ খেলি সেই এক আনন্দ। আরেক আনন্দ চিঠি ও কাব্যাদি লেখা।
অমিয় দুখানা চিঠি লিখেছিলেন। তুমি কি শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে কিছু লিখছো? আমি সত্বর সুরু করবো।
বন্ধু,
Departmentalএ ফেল করবো এ একেবারে মৃত্যুর মতো নিশ্চিত। এতএব আজকের এই বাদলা অপরাহ্নটিতে তোমার সঙ্গে আলাপ করবো। কোকিল ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে অশ্রান্ত আলাপ করছে–ভবানীপুরে বা আলিপুরে শুনতে পাও?
আমার বিয়ের সম্বন্ধ ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে। তোমার আসে? সাহিত্য তো তুমিও লেখো, কিন্তু কেউ কি তাই পড়ে তোমাকে মন-প্রাণ সঁপে? যদি আই-সি-এসটা কোনোক্রমে পাশ করে থাকতে, তবে হঠাৎ সবাই তোমার সাহিত্যের দরুণ তোমাকে পতিরূপে কামনা করতে। এবং তুমি প্রত্যাখ্যান করলে hunger strike করতো। এই কয়েক মাসে আমার ভারি মজার মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে। বলব তোমাকে।
অনেক সুন্দর সুন্দর গল্পের প্লট মাথায় ঘুরছে। লিখে উঠতে পারছিনে। সমাজটাকে আরেকটু ভালো করে দেখতে-শুনতে চাই। কিন্তু এ চাকরীতে থেকে সমাজের সঙ্গে point of contact জোটেনা। আমরা ক্লাব-চর জীব। ক্লাবে সম্প্রতি বাঙালী মেয়ের দুর্ভিক্ষ।
Departmentalএর সময় কলকাতায় যে কদিন থাকবে সেই সময়ের মধ্যে জনকয়েক সাহিত্যিককে চা খাওয়াতে চাই। সেই সূত্রে পরিচয় হবে। তুমি নাম suggest করে দেখি।