তারা নাকি আবিষ্কার করেছে–পাপী পাপ করেনা, পাপ করে মানুষ, বা আরো স্পষ্ট করে বল্লে মানুষের সামান্য ভগ্নাংশ; মানুষের মনুষত্ব দুনিয়ার সমস্ত পাপের পাওনা অনায়াসে চুকিয়েও দেউলে হয়না!
এ আবিষ্কারের দায়িত্বটুকু পৰ্যন্ত নিজেদের ঘাড়ে না নিয়ে তারা নাকি বলে বেড়ায়—বুদ্ধ খৃষ্ট চৈতন্যের কাছ থেকে তারা এগুলি বেমালুম চুরি করেছে মাত্র।
মানুষের একটা দেহ আছে এই অশ্লীল কিংবদন্তীতে তারা নাকি বিশাস করে এবং তাদের নাকি ধারণা যে, এই পরম রহস্যময় অপরূপ দেহে অশ্লীল যদি কিছু থাকে ত সে তাকে অতিরিক্ত আবরণে অস্বাভাবিক প্রাধান্য দেবার প্রবৃত্তি।
-ইতি।
কিন্তু অভিজাত, নিষ্কর্মা, মানবহিতৈষী সমাজরক্ষক আর্টত্রাতারা থাকতে ইতি হবার জো নেই।
এই সব সুস্থ সবল নীতিবলে বলীয়ান মানবজাতির স্বনিযুক্ত ত্রাতা ও খেচ্ছাসেবকদের সাধু ও ঐকান্তিক অধ্যবসায়ে আমাদের ঘোরতর আস্থা আছে!
মানুষের এই সামান্য তিন চার হাজার বছরের ইতিহাসেই তাঁদের হিতৈষী হাতের চিহ্ন বহু জায়গায় সুস্পষ্ট।
কল্লোল ও কালি-কলম দুটি ক্ষীণপ্রাণ কাগজের কণ্ঠদলন ত সামান্য কথা। কালে হয়ত তারা পৃথিবীর সমস্ত বিদ্রোহী ও বেসুরো কণ্ঠকেই একেবারে স্তব্ধ করে ধরণীকে শ্লীলতা ও সভ্যতার এমন স্বর্ণ করে তুলতে পারেন যে, অতিবড় নিন্দুকেরও প্রমাণ করতে সাধ্য হবেনা, রামের জ্যামিতিক জীবন থেকে শ্যামের জ্যামিতিক জীবন বিন্দুমাত্র তফাৎ; এবং মাতা ধরিত্রী এতগুলি ছাঁচে-কাটা সুসন্তান বারণ করবার পরম আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে সূর্যের অগ্নিজঠরে পুনঃপ্রবেশ করে আত্মহত্যা করতে চাইবেন। এতদূর বিশ্বাসও আমাদের আছে।
তবে মানুষ আসলে সমস্ত শ্লীলতার চেয়ে পবিত্র ও সমস্ত ভব্যতার চেয়ে মহৎ-এই যা ভরসা।
আমি আরেকটু যোগ করে দিই। যেখানে দাহ সেখানেই তো দ্যুতির সম্ভাবনা, যেখানে কাম সেখানেই তো প্রেমের আবির্ভাব। সুতরাং স্বীকার করো, আশীর্বাদ করো।
এই প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্রের মুন্সিগঞ্জ সাহিত্য-সম্মিলনীর অভিভাষণ থেকে কিছু অংশ তুলে দিলে মন্দ হবেন।
এমনই ত হয়; সাহিত্য-সাধনায় নবীন সাহিত্যিকের এই ত সব চাইতে বড় সান্ত্বনা। সে জানে আজকের লাঞ্ছনাটাই জীবনে তার একমাত্র এবং সবটুকু নয়, অনাগতের মধ্যেও তার দিন আছে। হোক সে শতবর্ষ পরে, কিন্তু সেদিনের ব্যাকুল ব্যথিত নর-নারী শত-লক্ষ হাত বাড়িয়ে আজকের দেওয়া তার সমস্ত কালি মুছে দেবে।…আজ তাকে বিদ্রোহী মনে হতে পারে, প্রতিষ্ঠিত বিধব্যবস্থার পাশে তার রচনা আজ অদ্ভুত দেখাবে, কিন্তু সাহিত্য ত খবরের কাগজ নয়। বর্তমানের প্রাচীর তুলে দিয়ে ত তার চতুঃসীমা সীমাবদ্ধ করা যাবেনা। গতি তার ভবিষ্যতের মাঝে। আজ যাকে চোখে দেখা যায়না, আজও যে এসে পৌঁছয়নি, তাই কাছে তার পুরস্কার, তারই কাছে তার সংবর্ধনার আসন পাতা আছে।
আগেকার দিনে বাংলা সাহিত্যের বিরুদ্ধে আর যা নালিশই থাক, দুর্নীতির নালিশ ছিলনা; ওটা বোধকরি তখনও খেয়াল হয়নি। এটা এসেছে হালে।…সমাজ জিনিষটাকে আমি মানি, কিন্তু দেবতা বলে মানিনে। নর-নারীর বহুদিনের পুঞ্জীভূত বহু কুসংস্কার, বহু উপদ্রব এর মধ্যে এক হয়ে মিশে আছে। কিন্তু একান্ত নির্দয় মূর্তি দেখা দেয় কেবল নর-নারীর ভালবাসার বেলায়।… পুরুষের তত মুস্কিল নেই, তার ফাঁকি দেবার রাস্তা খোলা আছে। কিন্তু কোনও সূত্রেই যার নিষ্কৃতির পথ নেই সে শুধু নারী। তাই সতীত্বের মহিমা প্রচারই হয়ে উঠেছে বিশুদ্ধ সাহিত্য।…একনিষ্ঠ প্রেমের মর্যাদা নবীন সাহিত্যিক বোঝে, এর প্রতি তার সম্মান ও শ্রদ্ধার অবধি নাই, কিন্তু সে যা সইতে পারেন, তা হচ্ছে ফাঁকি।…সতীত্বের ধারণা চিরদিন এক নয়। পূর্বেও ছিলনা, পরেও হয়ত একদিন থাকবেনা। পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব সতীত্বের চেয়ে বড়।…
তবে একটা নালিশ এই করা যেতে পারে যে, পূর্বের মত রাজা-রাজড়া জমিদারের দুঃখদৈন্যদ্বন্দ্বহীন জীবনেতিহাস নিয়ে আধুনিক সাহিত্যসেবীর মন আর ভরে না। তারা নীচের স্তরে নেমে গেছে। এটা আপশোষের কথা নয়। বরঞ্চ এই অভিশপ্ত অশেষ দুঃখের দেশে নিজের অভিমান বিসর্জন দিয়ে রুশ সাহিত্যের মত যে দিন সে আরও সমাজের নীচের স্তরে নেমে গিয়ে তাদের সুখ-দুঃখ-বেদনার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে, সেদিন এই সাহিত্যসাধনা কেবল স্বদেশ নয়, বিশ্বসাহিত্যেও আপনার স্থান করে নিতে পারবে।
এইবার বিরোধী দলের ‘নব-সাহিত্য-বন্দনাটা’ আবার মনে করিয়ে দিই।
রাজ্যোদ্যানে চিলে বস্তি,
স্বস্তি নব সাহিত্য স্বস্তি,
পথ-কর্দমে ধূলি ও পঙ্কে
ঘোষিলে আপন বিজয়-শঙ্খে,
লাঞ্ছিত পতিতার উদঘাটিলে দ্বার
সতীত্বে তাহারে কৈলে অভিষিক্ত–
জয় নব সাহিত্য জয় হে।
কালি-কলমের মামলা উপলক্ষ্য করে আরো একজন এগিয়ে এল। চিত্রবহার জন্যে লড়তে। সে অন্নদাশঙ্কর। তখন সে বিলেতে, চিত্রবহা চেয়ে নিয়ে পড়ল সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর তার প্রশংসায় দীর্ঘ এক প্রবন্ধ লিখলে। সেটা নবশক্তিতে ছাপা হল। লিখলে মুরলীদাকে: মোকদ্দমার রায়ে খুশি হতে পারলাম না। আসল প্রশ্নের মীমাংসা হলো কই? আমাদের সাহিত্যিকদের ম্যানিফেস্টো কই?
লণ্ডন থেকে আমাকে লেখা অন্নদাশঙ্করের একটা চিঠি এখানে তুলে দিচ্ছি:
শুদ্ধাস্পদেষু
কল্লোলের বৈশাখ সংখ্যার প্রতীক্ষায় ছিলুম। আপনার বেদে পড়ে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন সে কথা মোটের ওপর আমার কথা। কিন্তু আমার মনে হয় মিথুনাসক্তি নিয়ে আরেকটু ব্যাপকভাবে ভাববার সময় এসেছে। হঠাৎ একই যুগে এতগুলো ছোট-বড়-মাঝারি লেখক মিথুনাসক্তিকে অত্যধিক প্রাধান্য দিতে গেল কেন? দেখে শুনে মনে হয় বিংশ শতাব্দীর লেখকমাত্রই যেন Keatsএর মতো বলতে চায়, I felt like some watcher of the skies when a new planet swims into his ken. আলিবাবার সামনে যেন পাতালপুরীর দ্বার খুলে গেছে। শোনো শোনো অমৃতের পুত্রগণ, আমি জেনেছি সেই দুর্বার প্রবৃত্তিকে, যে প্রবৃত্তি সকল কিছুকে জন্ম দেয়, যে প্রবৃত্তিকে স্বীকার করলে মরণ সত্ত্বেও তোমরা বাঁচবে–তোমাদের থেকে যারা জন্মাবে তাদের মধ্যে বাঁচবে। আর এই সংসারে কেবল সেই প্রবৃত্তিই সার, অনিত্য এই জগতে কেবল সেই প্রবৃত্তিই নিত্য।—এ যুগের ঋষিরা যেন এই তত্বই ঘোষণা করেছেন। Personal immortality-তে তাঁদের আস্থা নেই–race immortality-ই তাদের একমাত্র আশা। এবং race immortality-র কুঞ্চিকা হচ্ছে Sex। যে বস্তু গত কয়েক শতাব্দীয় বিশ্বব্যাপী বুর্জোয়া সাহিত্যে taboo হয়েছিল কিম্বা বড় জোর রেষ্টোরেশন যুগের ইংলণ্ডে ব ভারতচন্দ্রীয় যুগের বাংলাদেশে বৈঠকখানাবিহারী বাবুদের মদের সঙ্গে চাটের স্থান নিয়েছিল সেই বস্তুই আজকের সমস্যাসংকুল বিশ্বে নতুন নক্ষত্রের মতো উদয় হলো। একে যদি বিকারের লক্ষণ মনে করা যায় তবে ভুল করা হবে। আসলে এটা হচ্ছে প্রকৃতি পুনরাবিষ্কার। মানুষের গভীরতম প্রকৃতি বহু শত বছরের কৃত্রিমতার তলায় তলিয়ে গিয়েছিল। এতদিনে পুনরুদ্ধারের দিন এলো। অনেকখানি আবর্জনা না সরালে পুনরুদ্ধার হয়না। অথচ আবর্জনা সরানো কাজটা বড় অরুচিকর। Sex সম্বন্ধে ঘাটাঘাটি সেইজন্যে বড় বীভৎস বোধ হচ্ছে। কিছুকাল পরে এই বীভৎসতা-এই বিশ্রী কৌতূহল—এই আধেক ঢেকে আধেক দেখানো—এসব বাসি হয়ে যাবে। Sexকে আমরা বিস্ময়সহকারে প্রণাম করবো, আদিম মানব যেমন করে সূর্যদেবতাকে প্রণাম করতো। এখনো আমরা sophistication কাটিয়ে উঠতে পারিনি বলে বাড়াবাড়ি করছি। কিন্তু এমন যুগ আসবেই যখন জন্মরহস্যকে আমরা অলৌকিক অহেতুক অতি বিস্ময়কর বলে নতুন ঋগ্বেদ রচনা করবো, নতুন আবেস্তা, নতুন Genesis. ভগবানকে পুনরাবিষ্কার করা বিংশ শতাব্দীর সব চেয়ে বড় কাজ—সেই কাজেই অঙ্গ সৃষ্টিতত্ত্ব পুনরাবিষ্কার। বিজ্ঞান ভাবীকালের মহাকাব্য রচনার আয়োজন করে দিচ্ছে—এইবার আবির্ভাব হবে সেই মহাকবিদের যাঁরা অষ্টোত্তর শত উপনিষৎ লিখে সকলের অমৃতত্ব ঘোষণা করবেন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সন্ধি হবে তখন। দেহ ও মনের বহুকালীন এটারও নিষ্পত্তি হবে সেই সঙ্গে।…