তার স্ত্রী নীলিমা বসুও কল্লোলযুগের লেখিকা। এবং অকালপ্রয়াতা। নিম্ন মধ্যবিত্তের সংসার নিয়ে গল্প লেখতেন। বিষয়ের আনুকূল্যে লিখনভঙ্গিতে একটি স্বচ্ছ সারল্য ছিল। এই সারল্য অনেক নীরব অর্চনার ফল।
কালি-কলমের মামলা উপলক্ষ্য করে শচীন সেনগুপ্ত আধুনিক সাহিত্যের সমর্থনে অনেক লিখেছিলেন তার নবশক্তিতে। তার আগে তার আত্মশক্তিতে। শচীন সেনগুপ্ত নিজেও একজন বিপ্লবী নাট্যকার, তাঁর নাটক ঝড়ের পরে উপলক্ষ্য করেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ঘুরন্ত রঙ্গমঞ্চ তৈরি হয়। নিজেও তিনি ভাঙনের রঙে ভাবনাগুলিকে রাঙিয়ে নিয়েছেন, তাই কল্লোলের লেখকদের সঙ্গে তার একটা অন্তরের ঐক্য ছিল। দারিদ্রের সঙ্গে এক ঘরে বাস করতেন, এক ছিন্ন শয্যায়— অনুচর বলতে নৈরাশ্য বা নিরাশ্বাস। তবু সমস্ত শ্রীহীনতার ঊর্ধ্বে একটি মহান স্বপ্ন ছিল-কষ্টের উত্তরে নিষ্ঠা, উপবাসের উত্তরে উপাসনা। এমন লোকের সঙ্গে কল্লোলের আত্মীয়তা হবে না তো কার হবে?
আরো একজন গুপ্ত-হীন গুপ্ত লেখক ছিলেন—অরসিক রায়ের ছদ্মনামে। খুচরো ভাবে খোঁচা মারতেন, তাতে ধার থাকলেও ভার ছিলনা। তখনকার দিনে আধুনিক সাহিত্যকে অশ্লীল বলাই ফ্যাশান ছিল যেমন এককালে ফ্যাশান ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখাকে দুর্বোধ্য বলা। আশীর্বাদ করতেই অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়, অনেক দীর্ঘদর্শিতার। যারা লেখক নন, শুধু সমালোচক, তাদের কাছে এই সহানুভূতি, এই দুরব্যাপিতা আশা করা যাবে কি করে? নগদবিদায়ের লেখক হয় জানি, তাঁরা ছিলেন নগদ-বিদায়ের সমালোচক। তাই যারা আধুনিক সাহিত্যের স্বস্তিবাচন করেছেন-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র থেকে রাধাকমল-ধূর্জটিপ্রসাদ পর্যন্ত তাদেরকেও ওঁরা রেহাই দেননি।
রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ। তিনি একদেশদর্শীর মত শুধু দোষেরই সন্ধান নেননি, যা প্রশংসনীয় তাকেও সংবর্ধনা করেছেন। তিনি জানতেন এক লেখা আরেক লেখাকে অতিক্রম করে যায় বারে-বারে, আজ যা প্রতিমা কালকে আবার তা মাটি—আবার মাটি থেকেই নতুনতরো মূর্তি। তাই আজ যা ঘোলা কাল তাই সুনির্মল। প্রশ্ন হচ্ছে বেগ আছে কিনা স্রোত আছে কিনা—আবদ্ধ থাকলেও আছে কিনা বন্ধনহীনের বৃষ্টিপাত। তাই সেদিন তিনি শৈলজা-প্রেমেন বুদ্ধদেব-প্রবোধ কাউকেই স্বীকার করতে বা সংবর্ধনা করতে কুণ্ঠিত হননি। সেদিন তাই তিনি লিখেছিলেন:
সব লেখা লুপ্ত হয়, বারম্বার লিখিবার তরে
নূতন কালের বর্ণে। জীর্ণ তোর অক্ষরে অক্ষরে
কেন পট রেখেছিস পূর্ণ করি। হয়েছে সময়
নবীনের তুলিকারে পথ ছেড়ে দিতে। তোক লয়
সমাপ্তির রেখা-দুর্গ। নবলেখা আসি দর্পভরে
তার ভগ্ন স্তূপরাশি বিকীর্ণ করিয়া দূরান্তরে
উন্মুক্ত করুক পথ, স্থাবরের সীমা করি জয়,
নবীনের রথযাত্রা লাগি। অজ্ঞাতের পরিচয়
অনভিজ্ঞ নিক জিনে। কালের মন্দিরে পূজাঘরে
যুগ-বিজয়ার দিনে পুজার্চ্চনা সাঙ্গ হলে পরে
যায় প্রতিমার দিন। ধূলা তারে ডাক দিয়া কয়,–
‘ফিরে ফিরে মোর মাঝে ক্ষয়ে ক্ষয়ে হবিরে অক্ষয়,
তোর মাটি দিয়ে শিল্পী বিরচিবে নূতন প্রতিমা,
প্রকাশিবে অসীমের নব নব অন্তহীন সীমা।।’
আসলে, কী অভিযোগ এই আধুনিক সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধে?
এই সম্বন্ধে কল্লোলে একটা জবানবন্দি বেরোয় নতুন লেখকদের পক্ষ থেকে। সেটা রচনা করে কৃত্তিবাস ভদ্র, ওরফে প্রেমেন্দ্র মিত্র।
নতুন লেখকেরা নাকি অশ্লীল।
পৃথিবীতে বুদ্ধ খৃষ্ট ও চৈতন্যেরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রাস্তায় চলে এ কথা তারা না হয় নাই মানল, মিথ্যা ও পাপকে ধামাচাপা দিলে যে মারা যায় এ কথাও নাকি তারা মানেনা!
তাদের পটে নাকি সাধুর মস্তক ঘিরে জ্যোতির্মণ্ডল দেখা যায়না, পাষণ্ডকেও নাকি সে পটে মানুষ বলে ভ্রম হয়। গায়ের অমোঘ নাকি সেখানে আগাগোড়া সমস্ত পরিচ্ছেদ সন্ধান করে শেষ পরিচ্ছেদে অভ্রান্ত ভাবে পাপীর মস্তকে পতিত হয়না।
‘নৌকাডুবির’ লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত কমলাকে রমেশের প্রতি স্বাভাবিক স্বতস্ফুর্ত প্রেম থেকে অর্থহীন কারণে বিচ্ছিন্ন করে অপরিচিত স্বামীর উদ্দেশ্যে অসম্ভব অভিসারে প্রেরণ না করে, ‘পথনির্দেশ’-এর রচয়িতা শ্ৰীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুটি মিলন-ব্যাকুল পরস্পরের সান্নিধ্যে সার্থক হৃদয়কে অপরূপ যথেচ্ছ পথ-নির্দেশ না করে তারা নাকি ঋষি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিখিলেশের বিমলাকে আত্মোপলব্ধির স্বাধীনতা দেওয়ার পরম অশ্লীলতাকে সমর্থন করে, সত্যদ্রষ্টা নির্ভীক শরৎচন্দ্রের সঙ্গে অভয়ার জ্যোতির্ময় নারীত্বকে নমস্কার করে!
সব চেয়ে তাদের বড় অপরাধ, তারা নাকি সাহিত্যে আভিজাত্য মানেনা। মুটে মজুর কুলি খালাসী দারিদ্র্য বস্তি ইত্যাদি যে সব অস্বস্তিকর সত্যকে সর্দি, বাত, স্থূলতা ইত্যাদির মতন অনাবশ্যক অথচ আপাতত অপরিহার্য বলে জীবনেই কোনরকমে ক্ষমা করা যায়—এবং বড় জোড় কবিতায় একবার-অন্ন চাই, প্রাণ চাই, চাই মুক্ত বায়ু ইত্যাদি বলে আলগোছে হা-হুতাশ করে ফেলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়, তারা সাহিত্যের স্বপ্ন-বিলাসের মধ্যে সে সবও নাকি টেনে আনতে চায়।
শুধু তাই! বস্তির অন্তরের জীবনধারাকে তারা প্রায় গ্যারেজওয়ালা প্রাসাদের অন্তরালের জীবনধারার মত সমান পঙ্কিল মনে করে। এমন কি, তারা মানে যে প্রাসাদপুষ্ট জীবনের বৈচিত্র্য ও মাধুৰ্য্য সময়েসময়ে বস্তির জীবনকে ধরি-ধরিও করে!