যতদূর মনে পড়ে, চিত্রবহার দুটি পরিচ্ছেদ নিয়ে নালিশ হয়েছিল। এক যৌবনবেদনা, দুই নরকের দ্বার। আর শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহের গোটাটাই।
সবচেয়ে আশ্চর্য, চিত্রবহকে প্রশংসা করেছিল শনিবারের চিঠি। এমন কি, তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছিল।
এই ভূতের-মুখে-রাম-নামের কারণ আছে। সুরেশবাবু মোহিতলালের বন্ধু। আর চিত্রবহ মোহিতলালের সুপারিশেই ছাপা হয় কালি-কলমে।
শনিবারের চিঠিতে চিত্রবহা সম্বন্ধে লেখা হয় :
..লেখক মানবজীবনের ভালো-মন্দ সুন্দর-কুৎসিত সকল দিকের মধ্য দিয়া একটা চরিত্রের বিকাশ ও জীবনের পরিণাম চিত্রিত করিয়াছেন। জীবনকে যদি কেহ সমগ্রভাবে দেখিবার চেষ্টা করেন তবে কিছুই বাদ দিবার প্রয়োজন হয়না। কারণ তাহা হইলে তাহার সৰ্বাংশের একটা সামঞ্জস্য ধরা পড়ে। কু ও সু দুই মিলিয়া একটি অখণ্ড রাগিনীর সৃষ্টি করে, তাহা morale নয়, immoraleও নয়—আরও বড়, আরও রহস্যময়।…
চমৎকার সুস্থ মানুরের মত কথা। ঋদ্ধিবাচন করতে জানে তাহলে শনিবারের চিঠি! তা জানে বৈকি। দলের হলে বা দরকার হলে করতে হয় বৈকি সুখ্যাতি। অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু।
নরেশচন্দ্র স্টেটমেন্টের খসড়া করে দিলেন। বললেন, প্রত্যেকে একখানা করে কপি কোর্টে পেশ করে দিন।
তথাস্তু। কিন্তু উকিলের দল ছাড়েন। বলে, ফাইট করুন। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মার খাবেন কেন?
বুঝবেনা কিছুতেই, উলটে বোঝাবে। ব্যাপারটা বুঝুন। এ ছেলেখেলা নয়, জরিমানা ছেড়ে জেল হয়ে যেতে পারে। ফরোয়ার্ডে না খেলুন গোলে গিয়ে দাঁড়ান। ফাঁকা গোলে বল মেরে পুলিশ জিতে যাবে এক শটে?
মহা বিড়ম্বনা। এক দিকে সমালোচক, অন্য দিকে পুলিশ, মাঝখানে উকিল। যেন একদিকে শেয়ালকুল অন্য দিকে বাবলা, মধ্যস্থলে খেজুর।
মুরলীধর তবু নড়েন না।
এর মশাই কোনো মানেই হয়না। হয় স্রেফ apologise করুন, আর না-হয় আমাদের লড়তে দিন। ফি-র ভয় করছেন, এক পয়সাও ফি চাইনা আমরা। সাহিত্যের জন্যে এ আমাদের labour of love।
মনে-মনে হাসলেন মুরলীধর। বললেন, ধন্যবাদ।
ভিড় ঠেলে আদালত-ঘরে ঢুকলেন তিনজনে। সার্জেন্ট আর লালপাগড়ি, গাঁটকাটা আর পকেটমার, চোর আর জুয়াড়ী, বেশ্যা আর গুণ্ডা, বাউণ্ডুলে আর ভবঘুরে। তারই পাশে প্রকাশক আর সম্পাদক, আর সাহিত্যিক।
ঢুকলেন প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট। কটা ছেঁড়া মামলার পর ডাক পড়ল কালি-কলমের।
কে জানে কেন, কাঠগড়ায় পাঠালেন না আসামীদের। চেয়ারে বসতে সংকেত করলেন।
এলেন মহামান্য পি-পি, হাতে একখণ্ড বাঁধানো কালি-কলম। অভিযুক্ত অংশবিশেষ নীল পেন্সিলে মোটা করে দাগানো। বইখানা যে তাকে সরবরাহ করেছে সে যে ভিতরের লোক তাতে সন্দেহ কি।
যারা আমাদের মতের ও পথের বিরোধী, অথবা ভিন্নপন্থী ও ভিন্নমত, তাদের অভ্যুদয় দেখলে আমাদের মন সংকুচিত বা অপ্রমুতি হয়। সেটা মনের আময়, অশুদ্ধতা। মনের সেই অপবিত্রতা দূর করবার জন্যে ভিন্নপন্থীদের পুণ্যাংশ চিন্তা করে মনে মুদিতা-ভাব আনা দরকার। পুষ্পহার দুজনকেই প্রসন্ন করে, যে ধারণ করে আর যে ঘ্রাণ নেয়। তেমনি তোমার অর্জিত পুণ্যের সৌরভে আমিও প্রমুদিত হচ্ছি। এই ভাবটিই। বিশুদ্ধ ভাব।
কিন্তু এ কি সহজ সাধনা? সাহিত্যিক হিসেবে যার আকাঙ্ক্ষিত যশ হলনা সে কি পারে পরের সাহিত্যধর্মে হৃদয়ে অনুমোদনভাব পোষণ করতে?
পি-পি বক্তৃতার পিপে খুললেন। এরা সমাজের কলঙ্ক, দেশের শত্রু, রাষ্ট্রের আবর্জনা। এদেরকে আর এখন নুন খাইয়ে মারা যাবেনা, যদি আইনে থাকত, লৌহশলাকায় বিদ্ধ করতে হত সর্বাঙ্গে।
আসামীদের পক্ষে কি বক্তব্য আছে? কিছু নয়, শুধু এই বিবৃতিপত্র। শুধু বাক্য থাকলেই কাব্য হয়না। বক্তৃতা দিয়ে রস বোঝানো যায়না অরসিককে।
সেই নামহীন উকিল তবু নাছোড়বান্দা। সে একটা বক্তৃতা ঝাড়বেই আসামীপক্ষে। বিনা পয়সায় এমন সুযোগ বুঝি আর তার মিলবেনা জীবনে।
আমাদের পক্ষে কোনো উকিল নেই। বললেন মুরলীধর : একমাত্র ভবিষ্যৎই আমাদের উকিল।
ম্যাজিষ্ট্রেট উকিলকে বসতে বললেন।
তারিখ পালটে তারিখ পড়তে লাগল। শেষে এল রায়-প্রকাশের দিন।
আদালতের বারান্দায় দুই বন্ধু প্রতীক্ষা করে আছে। শৈলজানন্দ আর মুরলীধর। সাহিত্য-বিচারে কী দণ্ড নির্ধারিত হয় তাদের! দারিদ্র আর প্রত্যাখ্যানের পর আর কী লাঞ্ছনা!
কি হবে কে জানে। শুষ্ক মুখে হাসল শৈলজা।
কি আবার হবে। বড়জোর ফাইন হবে। মুরলীধর উড়িয়ে দিলেন কথাটা।
শুধু ফাইনও যদি হয়, তাও দিতে পারবনা।
অগত্যা ওদের অতিথিই না হয় হওয়া যাবে দিন কতকের জন্যে। তাই বা মন্দ কি! মুরলীধর হাসলেন : গল্পলেখার নতুন খোরাক পাবে।
সেই লাভ। সান্ত্বনা পেল শৈলজা।
দুপুরের পর রায় বেরুল। পি-পির সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের আখ্যান-ব্যাখ্যান বিশেষ কাজে লাগেনি ম্যাজিস্ট্রেটের। আসামীদের তিনি benefit of doubt দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন।
আদর্শবাদী মুরলীধর। ইস্কুলমাস্টার ছিলেন, কিন্তু সেই সংকীর্ণ বন্দীদশা থেকে মুক্ত ছিলেন জীবনে। নিজে কখনো গল্প-উপন্যাস লেখেননি, প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় প্রসঙ্গ লিখেছেন—তাই ভয় ছিল ঐ সীমিত ক্ষেত্রে না মাস্টারি করে বসেন। কিন্তু না, চিরন্তন মানুষের উদার মহাবিদ্যালয়ে তিনি পিপাসু সাহিত্যিকের মতই চিরনবীন ছাত্র। সাহিত্যের একটি প্রশস্ত আদর্শের প্রতি আহিতলক্ষ্য ছিলেন। ভ্রষ্ট হননি কোনোদিন, স্বমতবিঘাতক মীমাংসা করেননি কোনো অবস্থায়। শুধু নিষ্ঠা নয়, নিষ্ঠার সঙ্গে প্রীতি মিশিয়েছেন। আর যেখানেই প্রতি সেখানেই অমৃতের আস্বাদ।