নিরুপম গুপ্ত ছদ্মবেশী। চট করে তাঁকে চিনে ফেলতে সকলেরই একটু দেরি হবে।
লেখরাজ সামন্ত শৈলজার ছদ্মনাম। কালিকলমে প্রকাশিত তার গল্প দিদিমণি আর প্রেমেনের গল্প পোনাঘাট পেরিয়ে সম্বন্ধে কাশীর মহেন্দ্র রায় আপত্তি জানান। তার আপত্তি, লেখা দুটো অশ্লীল, প্রকাশ-অযোগ্য। তেমনি তার আপত্তি নজরুলের মাধবী প্রলাপ ও মোহিতলালের নাগার্জুনের বিরুদ্ধে। এই নিয়ে মুরলীদার সঙ্গে পত্রে দীর্ঘকাল তাঁর তর্কবিতর্ক হয়। মুরলীদা বলেন, আপনার বক্তব্য গুছিয়ে প্রবন্ধ লিখুন একটা। মহেন্দ্র রায় আধুনিক সাহিত্যের উপর প্রবন্ধ লেখেন। তার পালটা জবাব দেন সত্যসন্ধ সিংহ। সত্যসন্ধ সিংহ ডক্টর নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের ছদ্মনাম।
শুধু প্রবন্ধ লিখেই তৃপ্তি পাচ্ছিলেননা মহেন্দ্রবাবু। তিনি একটা গল্পও লিখলেন। আর সেই গল্পই শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে।
এ কি ভাগ্যের রসিকতা। যিনি নিজে অশ্লীলতার বিরোধী তারই লেখা অশ্লীলতার দায়ে আইনের কবলে পড়বে!
ভাগ্যের রসিকতা আরো তৈরি হচ্ছে নেপথ্যে। নিন, আপনাদের দুজনকে—মুরলীধর বসু ও শিশিরকুমার নিয়োগীকে–গ্রেপ্তার করলাম। ভয় নেই, নিয়ে যাব না দড়ি বেঁধে। আমার নিজের দায়িত্বে কয়েক ঘন্টার জন্যে আপনাদের বেল দিয়ে যাচ্ছি। কাল বেলা এগারোটার মধ্যে আপনারা হাজির হবেন লালবাজারে। ইতিমধ্যে শৈলজাবাবুকেও খবর দিন, তিনিও যেন কাল সঙ্গে থাকেন। ঠিক সময় হাজির হবেন কিন্তু, নইলে–বুঝছেনই তো—আচ্ছা, এখন তবে আসি।
কাছেই বেঙ্গল-কেমিক্যালের আপিসে সুরেশবাবু কাজ করতেন। খবর পেয়ে ছুটে এলেন। তখুনি খানা-তল্লাসি আর গ্রেপ্তারের খবরটা নিজে লিখে দৈনিক বঙ্গবাণী আর লিবার্টি পত্রিকায় ছাপাতে পাঠালেন।
আর মুরশীদা ছুটলেন কালিঘাটে, শৈলজাকে খবর দিতে।
সব বুঝি যায়!
২১. মামলার রায় এবং অন্নদাশঙ্কর রায়
পরদিন সকালে মুরলীধর বসু আর শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় লালবাজারে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ভীতভয়সূদন শূলপাণির নাম গণ করতে-করতে।
প্রথমেই এক হোমরাচোমরার সঙ্গে দেখা। বাঙালি, কিন্তু বাংলাতে যে কথা কইছেন এ নিতান্ত কৃপাপরবশ হয়ে।
দেখতে তো সুখী-সজ্জনের মতই মনে হচ্ছে। আপনাদের এ কাজ?
পড়েছেন আপনি?
Darn it—আমি পড়ব ও সব ন্যাস্টি স্নাং? কোনো রেসপেকটেবল লোক বাংলা পড়ে?
তা তো ঠিকই। তবে আমাদেরটাও যদি না পড়তেন–
আমরা পড়েছি নাকি গায়ে পড়ে। আমাদেরকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে পড়িয়ে ছেড়েছে। আপনাদেরই বন্ধু মশাই। আপনাদেরই এক গোত্র।
কে? কারা?
সাহিত্যজগতের সব শূর-বীর, ধন-রত্ন—এক কথায় সব কেষ্টবিষ্টু। তাদের কথা কি ফেলতে পারি? নইলে এ সব দিকে নজর দেবার আমাদের ফুরসৎ কই? বোমা-বারুদ ধরব, না, ধরব এসব কাগজের ঠোঙা?
পুলিশপুঙ্গব ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। পরে মনে করলেন এ ভঙ্গিটা যথার্থ হচ্ছে না। পরমুহূর্তেই মেঘগম্ভীর হলেন। বললেন, রবিঠাকুর শরৎ চাটুজ্জে নরেশ সেন চারু বাঁড়য্যে—কাউকে ছাড়বনা মশাই। আপনাদের কেসটার নিষ্পত্তি হয়ে গেলেই ও-সব বড় দিকে ধাওয়া করব। তখন দেখবেন–
বিনয়ে বিগলিত হবার মতন কথা। গদগদ ভাষে বলেন মুরলীধর :
এ তো অতি উত্তম কথা। পিছুতে-পিছুতে একেবারে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত। তবে দয়া করে ঐ বড় দিক থেকে সুরু করলেই কি ঠিক হতনা?
না। প্রবলপ্রবর হুঙ্কার ছাড়লেন : গোড়াতে এই এটা একটা টেস্ট কেস হয়ে যাক।
রাঘববোয়াল ছেড়ে দিয়ে চিরকালই কি চুনোপুঁটিদের দিকে নজর? গদির অধিপতিদের ছেড়ে সামান্য মুদি-মনিহারি?
চালান হয়ে গেলেন পুলিশ-োকোর্টে।
সতীপ্রসাদ সেন—আমাদের গোরাবাবু-পুলিশ-কোটের উদীয়মান উকিল-জামিনের ব্যবস্থা করে দিলেন। মোক জোড়াবাগান কোর্টে স্থানান্তরিত হল। তারিখ পড়ল শুনানির।
এখন কি করাঅ্যা
প্রভাবান্বিত বন্ধু ছিল কেউ মুরলীধরের। তিনি এগিয়ে এলেন। বললেন, বলো তো, তারক সাধুকে গিয়ে ধরি। তারক যখন তখন নিশ্চয়ই ত্রাণ করে দেবেন। ত্রাহি মাং মধুসূদন না বলে ত্রাহি মাং তারকব্রহ্মন বলতে নিশ্চয়ই কাজ হবে।
মুরলীধর হাসলেন। বললেন, না, তেমন কিছুর দরকার নেই।
তা হলে কি করবে? এ সব বড় নোংরা ব্যাপার। আর্টের বিচার আর আদালতের বিচার এক নাও হতে পারে। আর যদি কনভিকশান হয়ে যায় তা হলে শাস্তি তো হবেই, উপরন্তু তোমার ইস্কুলের কাজটি যাবে।
তা জানি। তবু—থাক। মুরলীধর অবিচলিত রইলেন। বললেন, সাহিত্যকে ভালবাসি; পূজা করি সেবা করি সাহিত্যের। জীবন নিয়েই সাহিত্য-সমগ্র, অখণ্ড জীবন। তাকে বাদ দিয়ে জীবনবাদী হই কি করে? সু আর কু দুইই বাস করে পাশাশাশি। কে যে কী এই নিয়ে তর্ক। সত্য কতদূর পর্যন্ত সুন্দর, আর সুন্দর কতক্ষণ পর্যন্ত সত্য এই নিয়ে ঝগড়া। প্রুডারি আর পর্নোগ্রাফি দুটোকেই ঘৃণা করি। সত্যের থেকে নিই সাহস আর সুন্দরের থেকে নিই সীমাবোধ-আমরা স্রষ্টা, আমরা সমাধিসিদ্ধ।
ভদ্রলোক কেটে পড়লেন।
ঠিক হল লড়া হবেনা মামলা। না, কোনো তদবির-তালাস নয়, নয় ছুটোছুটি-হয়রানি। শুধু একটা স্টেটমেন্ট দাখিল করে দিয়ে চুপ করে থাকা। ফলাফল যা হবার তা হোক।
গেলেন ডক্টর নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তর কাছে। একে সার্থকনামা উকিল, তার উপরে সাহিত্যিক, সর্বোপরি অতি-আধুনিক সাহিত্যের পরাক্রান্ত পরিপোষক। অভিযুক্ত লেখা দুটো মন দিয়ে পড়লেন অনেকক্ষণ। বললেন, নট-গিলটি প্লিড করুন।