সাহিত্যের দোহাই ছেড়ে দিয়ে সমাজহিতের দোহাই দিতে পারো। আমার নিজের বিশ্বাস শনিবারের চিঠির শাসনের দ্বারাই অপর পক্ষে সাহিত্যের বিকৃতি উত্তেজনা পাচ্ছে। যে সব লেখা উৎকট ভঙ্গীর রান্না নিজের সৃষ্টিছাড়া বিশেষত্বে ধাক্কা মেরে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সমালোচনার খোঁচা তাদের সেই ধাক্কা মারাকেই সাহায্য করে। সম্ভবত ক্ষণজীবীর আয়ু এ-তে বেড়েই যায়। তাই যদি না হয়, তবু সম্ভবত এতে বিশেষ কিছু ফল হয় না। আইনে প্রাণদণ্ডের বিধান আছে, প্রাণহত্যাও থামছে না।
ব্যঙ্গরসকে চিরসাহিত্যের কোঠায় প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে আর্টের দাবী আছে। শনিবারের চিঠির অনেক লেখকের কলম সাহিত্যের কলম, অসাধারণ তীক্ষ্ণ, সাহিত্যের অস্ত্রশালায় তার স্থান-নব-নব হাস্যরূপের সৃষ্টিতে তার নৈপুণ্য প্রকাশ পাবে, ব্যক্তিবিশেষের মুখ বন্ধ করা তার কাজ নয়। সে কাজ করবারও লোক আছে, তাদের কাগজী লেখক বলা যেতে পারে, তারা প্যারাগ্রাফ-বিহারী।
আর একটা কথা যোগ করে দিই। যে সব লেখক বে-আব্রু লেখা লিখেছে, তাদের কারো কারো রচনাশক্তি আছে। যেখানে তাদের গুণের পরিচয় পাওয়া যায়, সেখানে সেটা স্বীকার করা ভালো। যেটা প্রশংসার যোগ্য তাকে প্রশংসা করলে তাতে নিন্দা করবার অনিন্দনীয় অধিকার পাওয়া যায়।
সঙ্গে-সঙ্গেই আবার রবীন্দ্রনাথ নবযৌবনের উদ্বোধন গাইলেন :
বাঁধন ছেঁড়ার সাধন তাহার
সৃষ্টি তাহার খেলা।
দস্যুর মতো ভেঙে-চুরে দেয়
চিরাভ্যাসের মেলা।
মূল্যহীনেরে সোনা করিবার
পরশ পাথর হাতে আছে তার,
তাইতো প্রাচীন সঞ্চিত ধনে
উদ্ধত অবহেলা।।
বলো ‘জয় জয়’, বলো ‘নাহি ভয়’–
কালের প্রয়াণ পথে
আসে নির্দ্দয় নব যৌব
ভাঙনের মহারথে।।
এই ভাঙনের রথে আরো একজন এসেছিলেন–তিনি জগদীশ গুপ্ত। সতেজ-সজীব লেখক, বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন। দুর্দান্ত সাহসে অনেক উদ্দীপ্ত গল্প লিখেছেন। বয়সে কিছু বড় কিন্তু বোধে সমান তপ্তোজ্জল। তারও যেটা দোষ সেটাও ঐ তারুণ্যের দোষ-হয়তো বা প্রগাঢ় পৌঢ়তার। কিন্তু আসলে যে তেজী তাকে কখনো দোষ অর্শে না। তেজীয়সাং ন দোষায়। যেখানে আগুন আছে সেখানেই আলো অলবার সম্ভাবনা। আগুন তাই অর্হনীয়।
জগদীশ গুপ্ত কোনো দিন কল্লোল-আপিসে আসেননি। মফস্বল শহরে থাকতেন, সেখানেই থেকেছেন স্বনিষ্ঠায়। লোককোলাহলের মধ্যে এসে সাফল্যের সার্টিফিকেট খোঁজেননি। সাহিত্যকে ভালোবেসেছেন প্রাণ দিয়ে। প্রাণ দিয়ে সাহিত্যরচনা করেছেন। স্বস্থান-সংস্থিত একনিষ্ঠ শিল্পকার।
অনেকের কাছেই তিনি অদেখা, হয়তো বা অনুপস্থিত। নদী বেগদ্বারাই বৃদ্ধি পায়। আধুনিক সাহিত্যের নদীতে তিনি একটা বড় রকমের বেগ। লম্বা ছিপছিপে কালো রঙের মানুষটি, চোখে বেশি পাওয়ারের পুরু চশমা, চোখের চাউনি কখনো উদাস কখনো তীক্ষ্ণ–মাথার চুলে পাক ধরেছে, তবু ঠোঁটের উপর কালো গোঁফজোড়াটি বেশ জমকালো। কালি-কলমকে তিনি অফুরন্ত সাহায্য করেছেন গল্প দিয়ে, সেই সম্পর্কে মুরলীদার সঙ্গে তার বিশেষ অন্তরঙ্গতা জমে ওঠে। যৌবন যে বয়সে নয়, মনের মাধুরীতে, জগদীশ গুপ্ত তার আরেক প্রমাণ।
বিখ্যাত জাপান বইর লেখক সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় পুরোপুরি ভারতীর দলের লোক। অথচ আশ্চর্য, পুরোপুরি কল্লোল-যুগের বাসিন্দা। একটি জাগ্রত সংস্কারমুক্ত আধুনিক মনের অধিকারী। কল্লোল বার হবার পর থেকেই কল্লোলে যাতায়াত করতেন, কালিকলম বেরুলে একদিন নিজের থেকেই সোজা চলে এলেন কালিকলমে। আধুনিক সাহিত্যপ্রচেষ্টায় তারা সক্রিয় সহানুভূতি—কেননা–কালি-কলমে নিজেই তিনি উপন্যাস লিখলেন চিত্রবহা—তা ছাড়া নবাগতদের মধ্যে যখন যেটুকু শক্তির আভাস দেখলেন অভ্যর্থনা করলেন। চারদিকের এত সব জটিল-কুটিলের মধ্যে এমন একজন সহজ-সরলের দেখা পাব ভাবতে পারিনি।
সঙ্গে এল তাঁর বন্ধু, প্রবোধ চট্টোপাধ্যায়। কাগজী-নাম আনন্দসুন্দর ঠাকুর। চেহারায় ও চরিত্রে সত্যিই আনন্দের। অন্তর-বাহিরে একটি রুচির পরিচ্ছন্নতা। রসঘন প্রবন্ধ লিখতেন মাঝে-মাঝে, প্রচ্ছন্নচারী একটি পরিহাস থাকত অন্তরালে। জীবনের গভীরে একটি শান্ত আনন্দ লালন করছেন তার মুখরুচি দেখলেই মনে হত। কিন্তু যখনই কল্লোলআপিসে ঢুকতেন, মুখে একটি করুণ আর্তি ফুটিয়ে শোকাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলে উঠতেন–সব বুঝি যায়!
সব বুঝি যায়! সে এক অপূর্ব শ্লেষোক্তি। সেই বক্রোষ্ঠিকা অননুকরণীয়।
কথাটা বোধহয় কল্লোলের প্রতিই বিশেষ করে লক্ষ্য করা। সমালোচকের যেটা কোপ তাকেই তিনি কাতরতায় রূপান্তরিত করেছেন।
কিছুই যায় না। সব ঘুরে-ঘুরে আসে। শুধু ভোল বদলায়।
কিন্তু কে জানত ভারতীয় দলের একজন প্রবীণ লেখকের উপন্যাসকে লক্ষ্য করে কালি-কলম-আপিসে পুলিশ হানা দেবে। শুধু হানা নয়, একেবারে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা নিয়ে এসেছে। কার বিরুদ্ধে? সম্পাদক মুরলীধর বসু আর শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় আর প্রকাশক শিশিরকুমার নিয়োগীর বিরুদ্ধে। অপরাধ? অপরাধ অশ্লীল-সাহিত্য-প্রচার।
আমরা সার্চ করব আপিস। সার্চ-ওয়ারেন্ট আছে। বললে লাল-পাগড়ি।
দুষ্য লেখাটা কি?
লেখা কি একটা? দুটো। সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস চিত্রবহা আর নিরুপম গুপ্তর গল্প শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে। নিন, বার করুন সংখ্যাগুলো–
মনে মনে হাসলেন মুরলীদা। নিরুপম গুপ্ত! সে আবার কে?