সে সবদিন নায়ক নায়িকার জন্মপত্রের ছক কেটে-কেটে আমাদের দিন যেত-প্রেমেনের আর আমার। কোন কক্ষে কোন চরিত্রের স্থিতি বা সঞ্চার এই নিয়ে গবেষণা। বাড়িতে বৈঠকখানা থাকবার মত কেউই সম্ভ্রান্ত নই, তাই কালিঘাটের গঙ্গার ঘাটে কিংবা হরিশ পার্কের বেঞ্চিতে কিংবা এমনি রাস্তায় টহল দিতে দিতে চলত আমাদের কূটতর্ক। যত লিখতাম তার চেয়ে কাটাকুটি করতাম বেশি—আর যদি একবার শেষ হল, গোটা বই তিন-তিনবার কপি করতেও পেছপা হলাম না। প্রথম উপন্যাস ছাপা হচ্ছে—সে উৎসাহ কে শাসন করে!
কিছু টাকা-কড়ি পাব এ আশাও ছিল হয়তো মনে মনে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা আর হাতে এল না, হাওয়াতে মিলিয়ে গেল।
এমনি অর্থাভাব প্রত্যেকের পায়ে-পায়ে ফিরেছে। সাপের নিশ্বাস ফেলেছে স্তব্ধতায়। হাঁড়ি চাপিয়ে চালের সন্ধানে বেরিয়েছে—প্রকাশক বলেছে, কেটে-ছেঁটে ছোট করুন বই, কিংবা হয়তো বায়না ধরেছে ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে তুলুন। আয়ের স্থিরতা না থাকলে কাম্যকর্মে ধৈর্য আসবে কি করে? অব্যবস্থ মন কি করে একাগ্র হবে? সর্বক্ষণ যদি দারিদ্র্যের সঙ্গেই যুঝতে হয় তবে সর্বানন্দ সাহিত্যসৃষ্টির সম্ভাবনা কোথায়? কোথায় বা সংগঠনের সাফল্য?
শৈলজা খোলার বস্তিতে থেকেছে, পানের দোকান দিয়েছিল ভবানীপুরে। প্রেমেন ওষুধের বিজ্ঞাপন লিখেছে, খবরের কাগজের প্রুফ দেখেছে। নৃপেন টিউশানি করেছে, বাজারের ভাড়াটে নোট লিখেছে। আর-আরো কেউ নির্বাক যুগের বায়স্কোপে টাইটেল তর্জমা করেছে, রাজামহারাজার নামে গল্প লিখে দিয়েছে, কখনো বা হোমরাচোমরা কারুর সভাপতির অভিভাষণ। যত রকমের ওঁচা মামলা। যদি সুদিনের দেখা পাই—যদি মনের মুক্ত হাওয়ায় বসে গভীর উপলব্ধির মৌনে সত্যিকারের কিছু সৃষ্টি করতে পারি একদিন।
বুদ্ধদেবের একটা চিঠি এখানে তুলে দিচ্ছি :
এখানে কিছুই যেন করার নেই—সন্ধ্যা কি করে কাটবে এ সমস্যা রোজ নতুন বিভীষিকা আনে। সঙ্গীরা যে যার কাজে ব্যস্ত; এমন কি টুনুও পরীক্ষা নিয়ে লেগেছে। প্রথমত, টাকা নেই। রাত নটা নাগাদ বাড়ি ফিরি–দেখি সমস্ত পাড়াটাই নিঃঝাম হয়ে গেছে;–অন্ধকার এক ঘর; নিজহাতে আলো জ্বালাতে হয়;–ঠাণ্ডা ভাত, ঠাণ্ডা বিছানা। কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমি যেন পাগল হয়ে গেছি। ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম;-পরে জেগে, যতক্ষণ আমার ঘুম না এল ভারি ভয় করতে লাগলো। মা নেই, সেইজন্যই বোধ হয় এত বেশি খারাপ লাগছে। নিজের হাতে চা তৈরী করতে হয়, সেইটে একটা torture. এদিকে আবার প্রেস সোমবারের মধ্যে নিদেন একশো টাকা চেয়েছে;-ওদের দোষ নেই, অনেকদিনের পাওনা, মোট ১৮০। এতদিন কোনোমতে আজ-কাল করে চালিয়ে আসছি;-এবারে না দিতে পারলে credit থাকবে না। কাগজের দোকানো ঢের পাবে; এমাসের কাগজ নগদ দাম ছাড়া আনা যাবে না। কি করে যে টাকার জোগাড় হবে কেউ জানে না। নিষ্কৃতির সহজ পন্থা হচ্ছে প্রগতির মহাপ্রয়াণ; কিন্তু প্রগতি ছেড়ে দেবো, এ কথা ভাবতেও আমার সারা মন যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে ওঠে। প্রগতির অভাব যেন প্রিয়ার বিরহের চেয়েও শত লক্ষ গুণে মর্মান্তিক ও দুঃসহ। একমাত্র উপায়—ধার;-কিন্তু আমাকে কে ধার দেবে? মার এমন কোনো গয়না-টয়নাও নেই যা কাজে লাগাতে পারি;-যা ছিলো আগেই গেছে। তবু চেষ্টার ত্রুটি করবে না, কিন্তু কোথাও পাবে কি-না, আমার এখন থেকেই সন্দেহ হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কি যে হবে, তা ভাবতেও আমার গা কালিয়ে আসে। যাক—এ বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারলাম কিনা, পরের চিঠিতেই জানতে পাবে।
এই বিষাদ ও দুশ্চিন্তার মধ্যে এক-এক সময় ইচ্ছে করে, ভয়ানক desperate একটা কিছু করে ফেলি—চুরি বা খুন বা বিয়ে। কিন্তু হায়! সেটুকু সৎসাহসও যদি থাকতো।
প্রবোধ যখন কল্লোলে এল তখন কল্লোল আরো জমজমাট হয়েছে।
আমার প্রথম একক উপন্যাসের নাম বেদে, আর প্রবোধের যাযাবর। এই নিয়ে শনিবারের চিঠি একটা সুন্দর রসিকতা করেছিল। বলেছিল, একজন বলছে : বে দে, আর অমনি আয়েকজন বলে উঠছে : যা, যা বর। লোকটার বিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়েছিল কিনা জানা যায়না, কিন্তু সভা ছেড়ে চলে যে যায়নি তাতে সন্দেহ কি। মুকুট না জুটুক, পিড়ি আঁকড়ে বসে আছে সে ঠিক।
এক দিকে যত ব্যঙ্গ, অন্য দিকে তত ব্যঞ্জনা। মিথ্যার পাশ কাটিয়ে নয়, মিথ্যার মূলোচ্ছেদ করে সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়াও। শাখায় না গিয়ে শিকড়ে যাও, কৃত্রিম ছেড়ে আদিমে; সমাজের গায়ে যেখানে-যেখানে সিল্কের ব্যাণ্ডেজ আছে তার পরিহাসটা প্রকট করো। যারা পতিত, পীড়িত, দরিদ্রিত, তাদেরকে বাঙ্ময় করে তোলে। নতুনের নামজারি করো চারদিকে। কি লিখবে শুধু নয় কেমন করে লিখবে, গঠনে কি সৌষ্ঠব দেবে, সে সম্বন্ধেও সচেতন হও। ঘোলা আছে জল, স্রোতে-স্রোতে পরিশ্রুত হয়ে যাবে। শুধু এগিয়ে চলো, সন্তরণ সিন্ধুগমন অনিবার্য।
ওরা যত হানবে তত মানবে আমাদের। চলো এগিয়ে।
বস্তুত বিরুদ্ধ পক্ষের সমালোচনাও কম প্ররোচনা জোগাতনা। ভঙ্গিতে কিছু ত্বরা ও ভাষায় কিছু অসংযম নিশ্চয়ই ছিল, সেই সঙ্গে ছিল কিছুটা শক্তিময় স্বকীয়তা। প্রতিপক্ষ শুধু খোসাভুষিই কুড়িয়েছে, সার-শস্যের দিকে দৃষ্টি দেয়নি। নিন্দা করবার অধিকার পেতে হলে যে প্রশংসা করতেও জানতে হয় সে বোধ সেদিন দুর্লভ ছিল। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে এক চিঠি লেখেন। সে চিঠি তেরেশ চৌত্রিশের মাঘ মাসের শনিবারের চিঠিতে ছাপা হয়। তার অংশবিশেষ এইরূপ :