সত্যি নিজেকে আর চিনতে পারি না। তোদের যে প্রেমেন বন্ধু ছিল তাকে আমার মধ্যে খুঁজে খুঁজে পাই না। মনে হয় গাছের যে ডালপালা একদিন দুবাহু মেলে আকাশ আর আলোর জন্যে তপস্যা করত, যার লোভ ছিল আকাশের নক্ষত্র, সে ডালপালা আজ যেন কে কেটেকুটে ছারখার করে দিয়েছে। শুধু অন্ধকার মাটির জীবন্ত গাছের মূলগুলো হাতড়ে-হাতড়ে অন্বেষণ করছে শুধু খাবার, মাটি আর কাদা, শুধু বেঁচে থাকা-কেঁচোর মত বেঁচে থাকা। এ প্রেমেন তোদের বন্ধু ছিল না বোধ হয়।
বাতি নিবে গেছে। হৃদয়ের বিষাক্তবাতাসে সে কতক্ষণ বাঁচতে পারে? যে প্রদীপ আলো দেয় তাহে ফেল শাস।।
মানুষের দিকে তাকিয়ে আজকাল কি দেখতে পাই আনিস? সেই আদিম পাশব ক্ষুধা-হিংসা, বিষ, আর স্বার্থপরতা। চোখের বাতায়ন দিয়ে শুধু দেখতে পাই সুসভ্য মানুষের অন্তরে আদিম পশু উৎ পেতে আছে। যে চোখ দিয়ে মানুষের মাঝে দেবতাকে দেখতুম সেটা আজ অন্ধপ্রায়। আমার যেন আজকাল ধারণা হয়েছে এই যে, লোকে বন্ধুকে ভালবাসে এটা নেহাৎ মিথ্যে—মানুষ নিজেকেই ভালবাসে। যে বন্ধুর কাছে অর্থাৎ যে মানুষের কাছে সেই নিজেকে ভালবাসার অহঙ্কারটা চরিতার্থ হয়, অর্থাৎ যার কাছ থেকে সে নিজের আত্মম্ভরিতার থোক পায় তাকেই সে ভালবাসে মনে করে। দরকার মানুষের শুধু নিজেকে, শুধু নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে সে অহঙ্কার চরিতার্থ করতে চায়। বন্ধু হচ্ছে মাত্র সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখবার আর্শি। ওই জন্যেই তাকে ভালবাসা। যে আর্শি থেকে নিজেকে সব চেয়ে ভাল দেখায় তাকেই বলি সব চেয়ে বড় বন্ধু। বন্ধুর জন্যে বন্ধুকে মানুষ ভালবাসে না-ওটা মিথ্যা কথা—মানুষ নিজের জন্যে বন্ধুকে ভালবাসে। শুধু স্বার্থ, শুধু স্বার্থ। তাই নয় কি?
আচ্ছা অচিন্ত্য, পড়েছিস তো, এতদিনে জানলেম যে কাঁদন কাদলেন সে কাহার জন্য? পেরেছিস কি জানতে? সে কি প্রিয়া? সে প্রিয়াকে পাব কি মেয়েমানুষের মধ্যে? কিন্তু কই? যার জন্যে জীবনভরা এই বিরাট ব্যাকুলতা সে কি ওইটুকু? দিনরাত্রি আকাশ-পৃথিবী ছাড়িয়ে গেল যার বিরহের কান্নায় সে কি ওই চপল ক্ষুদ্র ক্ষুধায় ভরা প্রাণীটা? যাকে নিঃশেষ করে সমস্ত জীবন বিলিয়ে দিতে চাই, যার জন্যে এই জীবনের মৃত্যু-বেদনা-দুঃখ-ভয়-সংকুল পথ বেয়ে চলেছি সে প্রিয়াকে নারীর ভেতর পাই কই ভাই। কার জন্যে কান্না জানি না বটে, কিন্তু কেন তা তো জানি—এ কথা তো জানি যে এটা দিতে চাওয়ার অশ্রান্ত কান্না। দেব, দেব-মায়ের স্তন যেমন দেবার কান্নায় ব্যথাভরা আনন্দে টলমল করে ওঠে, আমাদের সমস্ত জীবন যে তেমনি ব্যথায় কঁপছে। কিন্তু কে নেবে ভাই?…কে নেবে ভাই নিঃশেষ করে আমাকে, শিশির প্রেভাতের আকাশের মত নিঃস্ব, রিক্ত, শূন্য করে, বাশির বেণুর মত নিঃসম্বল করে—কে সে অচিন?
কি কথা বলতে চাই বলতে পারছি না। বুকের ভেতর কি কথার ভিড় বন্ধ ঘরে মৃগনাভির তীব্র ঘ্রাণের মত নিবিড় হয়ে উঠেছে, তবু বলতে পারছি না। কত রকমের কত কথা—তার না পাই খেই না পাই ফাঁক! হাহানার বন্ধ কুঁড়ির মত টনটন করছে সমস্ত প্রাণ—কিন্তু পারছি না
বলতে। কাল থেকে কতবার ছন্দে দুলিয়ে দিতে চাইলুম, পারলুম না। ছন্দ দোলে না আর। বোব বাঁশী যেন আমি, ব্যাকুল সুরের নিশ্বাস শুধু দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিযে যাচ্ছে—বাজাতে পারছি না। কত কথা ভাই—যদি বলতে পারতুম!
গলসওয়ার্দির Apple Tree পড়ছিলুম—না, পড়ে ফেলেছি আজ দুপুরে। সেই না-জানা আপেল-মঞ্জরীর সুবাস বুঝি এমন উদাস করেছে। তুই সেখানে পাস খুঁজে গলসওয়াদির Apple Tree গল্পটা পড়িস। Pan ছাড়া এ রকম love story পড়েছি বলে তো মনে পড়ছে না।
না, শুধু Apple Tree নয় ভাই, এই নতুন শরৎ আমার মনে কি যেন এক নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। মরতে চাই না, কিন্তু মরতে আর ভয়ও পাই না বোধ হয়। যে একদিন অযাচিত জীবন দিয়েছিল সেই আবার কেড়ে নেবে তাতে আর ভয় কিসের ভাই। তবে একটু সকাল-সকাল এই য। তাতে দুঃখ আছে, ভয়ের তো কিছু দেখি না। আজ পর্যন্ত তো ভাই কোটি-কোটি মানুষ এমনি করে চলে গেছে—এমনি করে নীল আকাশ শিউলি মেঘ সবুজ ঘাস বন্ধুর ভালবাসা ছেড়ে—নিস্ফল প্রতিবাদে। তবে? জীবন কেন পেয়েছিলাম তা যথন জানিনা, জানিনা যখন কোন পুণ্যে, তখন হারাবার সময় কৈফিয়ৎ চাইবার কি অধিকার আছে ভাই? খোঁড়া হয়ে জন্মাই নি, অন্ধ হয়ে জন্মাই নি, বিকৃত হয়ে জন্মাইনি—মার কোল পেলাম, বন্ধুর বুক পেলাম, নারীর হৃদয় পেলাম, তা যতটুকু কালের জন্যেই হোক না—আকাশ দেখেছি, সাগরের সঙ্গীত শুনেছি, আমার চোখের সামনে ঋতুর মিছিল গেছে বার বার, অন্ধকারে তারা ফুটেছে, ঝড় হেঁকে গেছে, বৃষ্টি পড়েছে, চিকুর খেলেছে—কত লীলা কত রহস্য কত বিস্ময়! তবে জীবনদেবতাকে কেন না প্রণাম করব ভাই! কেন না বলব ধন্য আমিনমো নমো হে জীবনদেবতা!
যা পেয়েছি তার মান কি রাখতে পেরেছি ভাই? কত অবহেলা কত অপচয় কত অপমান না করলুম! এখনো হয়তো করছি। তাই নো কেড়ে নেবে বলে জোর করে তাকে ভৎসনা করতে পারি না। জানি তুলনা করে তাকে দোষ দিয়েছি কতবার, কিন্তু কি সে যে ভুল ভাইতার খুশির দান তাতে আমার কি বলবার আছে? কারুর গলায় হয়তো সে বেশী গান দিলে, কাউকে প্রাণ বেশী, কাউকে সে সাজিয়ে পাঠালে, কাউকে না—আমায়ও তো সে রিক্ত করে জাগায়নি।