চৌষট্টি দিন রোগভোগের পর তার একটি ছেলে মারা যায়। যেদিন মারা গেল, সেদিনই দা ঠাকুর কল্লোলে এলেন। বললেন, চৌষট্টি দিন ড্র রেখেছিলাম, আজ গোল দিয়ে দিলে।
রাধারাণী দেবী কল্লোলে লিখেছেন—তিনি কল্লোল যুগেরই কবি। ইদানীন্তন কালে তিনিই প্রথম মহিলা যাঁর কবিতায় বিপ্লব আভাত হয়েছে। তখন তিনি দত্ত, দেবদত্ত হননি। এবং রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রাগৃহে আধুনিক সাহিত্যের যে বিচার-সভা বসে তাতে ফরিয়াদী পক্ষে প্রথম বক্ত রাধারাণী। সেদিনকার তাঁর সেই দার্ঢ্য ও দীপ্তি ভোলবার নয়।
হেমেন্দ্রলাল রায় ঠিক ভারতীর যুগে পড়েন না, আবার কল্লোল-এরও দলছাড়া। তবু কল্লোল-আপিসে আসতেন আড্ডা দিতে। স্বভাবসমৃদ্ধ সৌজন্যে সকলের সঙ্গে মিশতেন সতীর্থের মত। কল্লোল যখন মাঝেমাঝে বাইরে চড়াইভাতি করতে গিয়েছে, হয় বোটানিক্সে নয় তো কৃষ্ণনগরে, নজরুলের বা আফজলের বাড়িতে, তখন হেমেন্দ্রলালও সঙ্গ নিয়েছেন। উল্লাসে-উচ্ছ্বাসে ছিলেন না কিন্তু আনন্দে-আহ্লাদে ছিলেন। হৈ-হল্লাতে সামর্থ্য না থাকলেও সমর্থন ছিল। উন্মুক্ত মনের মিত্রতা ছিল ব্যবহারে।
কল্লোল-আপিসে একবার একটা খুব গম্ভীর সভা করেছিলাম আমরা। সেই ছোট, ঘন, মায়াময় ঘরটিতে অনেকেই একত্র হয়েছিল সেদিন। কালিদাস নাগ, নরেন্দ্র দৈব, দীনেশরঞ্জন, মুরলীধর, শৈলজা, প্রেমেন, সুবোধ রায়, পবিত্র, নৃপেন, ভূপতি, হরিহর এবং আরো কেউ-কেউ। সেদিন ঠিক হয়েছিল কল্লোলকে ঘিরে একটা বলবান সাহিত্য-গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে। যার মধ্য দিয়ে একটা মহৎ প্রেরণা ও বৃহৎ প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্য সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে। একটা কিছু বড় রকমের সৃষ্টি, বড় রকমের প্রজ্ঞা। সমস্ত বাধা বিপদ ও ব্যর্থ বিতর্ক উপেক্ষা করে একাগ্রসাধন।
দেখি সে সভায় কখন হেমেন্দ্রলাল এসে উপস্থিত হয়েছেন। নিঃশব্দে রয়েছেন কোণ ঘেঁসে। হেমেন্দ্রলাল কল্লোলের তেমন লোক যাকে কল্লোলের সভায় নিমন্ত্রণ না করলেও যোগ দিতে পারেন অনায়াসে।
মনে আছে সেদিনের সেই সভার চৌহদ্দিটা মিত্রতার মাঠ থেকে ক্রমে-ক্রমে অন্তরঙ্গতার অঙ্গনে ছোট করে আনা হয়েছিল। দীনেশদাকে ঘিরে সেদিন বসেছিলাম আমরা কজন। স্থির করেছিলাম, সাহিত্যিক সিদ্ধিও যোগজ সিদ্ধি—কেউ তাই বিয়ে করব না। অনন্যচেতা হয়ে বদ্ধপদ্মাসনে শুধু সাহিত্যেরই ধ্যান করব। শুধু তাই নয়, থাকব একসঙ্গে, এক ব্যারাকে, এক হাঁড়িতে! সকলের আয় একই লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে জড়ো হবে, দর বুঝে নয় দরকার বুঝে হবে তার সমান বাঁটোয়ারা। সুন্দর স্বপ্নের উপনিবেশ স্থাপন করব।
নৃপেন তো প্রায় তখুনি ব্যারাকের জায়গা খুঁজতে ছোটে। প্রেমেন গ্রামের পক্ষপাতী। দীনেশদা বললেন, যেখানেই হোক, নদী চাই, গঙ্গা চাই।
সুরতরঙ্গিনী পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা।
এই সময়কার চিঠি একটা দীনেশদার :
আমরা কি প্রত্যেক দিন ভাবি না, আমি শ্রান্ত ক্লান্ত, আর পারি না। অথচ আমরাই প্রান্তিকে অবহেলা করে শান্তি লাভ করি।
সর্বতোমুখী প্রতিভা আমাদের—এ সবগুলিকে একাগ্র ও একায়ত্ত করে নিতে হবে। আমাদের আমাকে স্বীকার করতে হবে। নিজেকে পূর্ণ করে নিতে হবে। ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ হোক বলে আমাদের তৃপ্তি হয় না, আমরা তার ইচ্ছা পূর্ণ করব বলেই এই অসীম শক্তি নিয়ে এসেছি। আমরা কে? আমরা তারা যারা রণোন্মত্ত বীরের মত উন্মুক্ত অসি নিয়ে মরণকে আহ্বান করে না—তারা, যারা অসীম ধৈর্যে ও করুণায় অক্ষয় শক্তি ও আনন্দ নিয়ে মৃত্যুকে বরাভয় দেয়। আমরা অভয় অভয়ার সন্তান। অমর বলে আমরা বলীয়ান—আমরা এক—বহুর অনুপ্রেরণা। আমরা দুর্বলের ভরস—দুর্যোধনের ভীতি। মহারাজ্যেশ্বরের অমৃতলোকের রথী আমরা—আমরা তার কিঙ্কর-কিঙ্করী নই।
অবসাদ-অভিমান আমাদের আসে, কিন্তু সকলকে তাড়িয়ে নয়, এ সকলকে ঘাড়ে করে উঠে দাঁড়াই আমরা। যত দুৰ্বার পথ সামনে পড়ে তত দুর্জয় হই। তাই নয় কি? আমরা যে এসেছিলাম, বেঁচেছিলাম, বেঁচে থাকবও–এ কথা পৃথিবীকে স্বীকার করতে হয়েছে, করতে হচ্ছে, হবে-ও।
ছিন্নভিন্ন এই হৃদয় আমাদের সাতখানে ছুটে বেড়ায়। এই ঘোটার মধ্যেই আমারা সত্যের সন্ধান পাই। সত্যের মৃগয়া করে আমাদের মন আবার ধ্যানলোকে ফিরে আসে। আমরা হাসি-কাঁদি, জীবনকে শতধা করে আমরাই আবার ভাঙা হাড় জোড়া লাগাই। এই ভাবটাই আমার আজকের চিন্তা, তোমাকে লিখলাম। প্রকাশের অক্ষমতা মার্জনা করো।
চার দিকে প্রলয়ের মেঘ, অগ্নিকুণ্ডের মাঝখানে বসে আছি, তবু মনে হয়, আসুক প্রলয়, তার সহস্র আক্রোশের শেষ পাওনাও তো আমায়।
সকলে ভাল। আজ বিদায় হই। তোমরা খবর দিও। জেগে ওঠ, বেঁচে ওঠ, হেঁইয়ো বলে তেড়ে ওঠ-দেখবে কাঁধের বোঝা বুকে করে চলতে পারছ। D.R.
কিছুকাল পরে বুদ্ধদেবের চিঠি পেলাম :
হঠাৎ বিয়ে করা ঠিক করে ফেললে যে? আমার আশঙ্কা হয় কি জানো? বিয়ে করে তুমি একেবারে তৈলস্নিগ্ধ সাধারণ ঘরোয়া বাঙালী না বনে যাও। গৃহশান্তিনিকেতনের আকর্ষণ কম নয়, কিন্তু সেটা পার্থিব-এবং কবিপ্রতিভা দৈব ও শতবর্ষের তপস্যার ফল। বাঁধা পড়ার আগে এই কথা ভালো করে ভেবে নেবে তো?
কল্লোলে আসবার আগেই হেমেন্দ্রলালের দেখা পাই। প্রেমেন আর আমি দুজনে যুক্তভাবে প্রথম উপন্যাস লিখছি। কাঁচা লেখা বলেই বইর নাম বাঁকালেখা ছিল তা নয়, জীবনের যিনি গ্রন্থকার তিনিই যে কুটিলাক্ষর—ছিল এমনি একটা গভীর বক্রোক্তি। তখন হেমেন্দ্রলালের সম্পাদনায় মহিলা নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরুত, শৈলজা আমাদের নিয়ে গেল সেখানে। শৈলজার উপন্যাস বাংলার মেয়ে ছাপা হচ্ছিল মহিলায়—সেটা শেষ হইতেই শুরু হয়ে গেল বাঁকালেখা। ক্রমে বইটা গ্রন্থকারিত হল। মূলে সেই হেমেন্দ্রলালের সহযোগ।