সবার চেয়ে নিকট ছিলেন নরেনদা। প্রায় জলধারদাদারই দোসর, তারই মত সর্বতোভদ্র, তাঁরই মত নিঃশত্রু। আর-আমরা কল্লোল-আপিসে কদাচিৎ আসতেন, কিন্তু নরেনদাকে অমনি কালে-ভদ্রের ঘরে ফেলা যায়না। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, ওরফে বুড়োদা, খুব একজন কইয়ে-বইয়ে লোক, ফুর্তিবাজ গল্পে, হেমেনদা আবার তেমনি গম্ভীর, গভীরসঞ্চারী। মাঝখানে নরেনদা, পরিহাস প্রসন্ন, যে পরিহাস সব অবস্থায়ই মাধুর্যমার্জিত। কল্লোলে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাসে তিনি এক চমকপ্রদ উক্তি করেন। ঠিক তিনি করেন না, তাঁর নায়ককে দিয়ে করান। কথাটা আসলে নির্দোষ নিরীহ, কিন্তু সমালোচকরা চমকে ওঠে বলেই চমকপ্রদ। Cousins are always the best targets. সমাজতত্ত্বের একটা মোটা কথা, যার বলে বর্তমানে হিন্দু বিবাহ-আইন পর্যন্ত সংশোধিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেকালে ঐ সরল কথাটাই সমালোচকের বিচারে অশ্লীল ছিল। যা কিছু চলতি মতের পন্থী নয় তাই অশ্লীল।
শনিবারের চিঠি প্রতি মাসে ‘মণিমুক্তা’ ছাপত। খুব যত্ন করে আহরণ করা রত্নাবলী। অর্থাৎ কোনখানে কোথায় কি বিকৃতি পাওয়া যায় তাই বেছে বেছে কুড়িয়ে এনে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন করা। বেশির ভাগই প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন, খাপছাড়া ভাবে খানিকটা শিথিল উদ্ধৃতি। ভাই ও সবকে শুধুমণি না বলে মধ্যমণিও বলা চলে। একখানা কল্লোল বা কালিকলম, প্রগতি বা ধূপছায়া কিনে কি হবে, তার চেয়ে একখানা শনিবারের চিঠি কিনে আনি। এক থালায় বহু ভোজ্যের আস্বাদ ও আঘ্রাণ পাব। সঙ্গে-সঙ্গে বিবেককেও আশ্বাস দিতে পারব, সাহিত্যকে শ্লীল, ধর্মকে খাঁটি ও সমাজকে অটুট রাখবার কাজ করছি। একেই বলে ব্যবসার বাহাদুরি। বিষ যদি বিষের ওষুধ হয়, কণ্টক যদি কণ্টকের, তবে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে অশ্লীলতাই বা ব্যবহার করা যাবে না কেন? আর কে না জানে, যদি একটু ধর্মের নাম একটু সমাজস্বাস্থ্যের নাম ঢোকানো যায় তবে অশ্লীলতাও উপাদেয় লাগে।
এই সময় হসন্তিকা বেরোয়। উদ্যোক্তা ভারতীর দলের শেষ রথীরা। শুনতে মনে হয় হাসির পত্রিকা, কিন্তু হসন্তিকার আসল অর্থ হচ্ছে ধুনুচি, অগ্নিপাত্র। তার মানে, সে হাসাবেও আবার দগ্ধও করবে। অর্থাৎ এক দিকে শনিবারের চিঠিকে ঠুকবে অন্য দিকে আধুনিক সাহিত্যের পিঠ চাপড়াবে। মতলব যাই থাক ফল দাঁড়াল পানসে। শনিবারের চিঠির তুলনায় অনেক জোলো আর হালকা। অত জোরালো তো নয়ই, অমন নির্জলাও নয়।
শনিবারের চিঠির মণিমুক্তার বিরুদ্ধে আক্ষেপ করছে হসন্তিকা:
আমরা সখের মেথর গো দাদা, আমরা সখের মুর্দ্দফরাস
মাথায় বহিয়া ময়লা আনিয়া সাজাই মোদের ঘরের ফরাস।
শকুনি গৃধিনী ভাগাড়ের চিল, টেক্কা কে দেয়, মোদের সাথ?
যেখানে নোংরা, ছো মারিয়া পড়ি, তুলে নিই ত্বরা ভরিয়া হাত।
গলা ধ্বসা যত বিকৃত জিনিস কে করে বাছাই মোদের মতো?
আমরা জহুরি পচা পঙ্কের যাচাই করা তো মোদের ব্রত!
মোদের ব্যাসাতি ময়লা-মাণিক আস্তাকুড় যে ক্ষেত্র তার,
নর্দ্দমা আর পগার প্রভৃতি লয়েছি কায়েমী ইজারা ভার!
আর যাই হোক, খুব জোরদার ব্যঙ্গ কবিতা নয়। আর, প্রত্যুত্তরে শনিবারের চিঠির ব্যঙ্গ হল কবিতাটাকেই মণি-মুক্তার নথিভুক্ত করা।
বুদ্ধদেবের চিঠি :
তোমার চিঠিখানা পড়ে ভারি আনন্দ হল। এক-একবার নতুন করে প্রগতির প্রতি তোমার যথার্থ প্রীতি ও শ্রদ্ধার পরিচয় পাই-আর বিস্ময়ে ও আনন্দে মনটা ভরে যায়। আমরা নিজেরা দুচারজন ছাড়া প্রগতিকে এমন গভীর ভাবে কেউ cherish করে না একথা জোর করে বলতে পারি। প্রথম যখন প্রগতি বার করি তখন আশা করিনি তোমাকে এতটা নিকটে পাওয়ার সৌভাগ্য হবে।
চিঠিতেই প্রায় one-third গ্রাহক ছেড়ে দিয়েছে; ভি পি তো সবে পাঠালাম-কটা ফেরৎ আসে বলা যায় না। আরম্ভ মোটেই promising নয়। তবু একেবারে নিরাশ হবার কারণ নেই বোধ হয়। নতুন গ্রাহকও দুচারজন করে হচ্ছে—এ পর্যন্ত চারজনের টাকা পেয়েছি—আরো অনেকগুলো promise পাওয়া গেছে। মোটমাট গ্রাহক সংখ্যা এবার বাড়বে বলেই আশা করি—গত বছরের সংখ্যার অন্তত দেড়গুণ হতে বাধ্য শেষ পর্যন্ত। তা ছাড়া advt.ও বেশ কিছু পাওয়া যাচ্ছে। ও বিজ্ঞাপনটা নরেন দেব দিয়েছেন—ওঁর নিজের বইগুলোর। আগে ইচ্ছে ছিল বিনি পয়সায় ছাপানোর–পরে মাসে পাঁচ টাকা দিতে রাজি হয়েছেন। মন্দ কি?
হসন্তিকা পড়েছি। তুমি যা বলেছ সবই ঠিক কথা। এক হিসেবে শনিবারের চিঠির চাইতে হসস্তিকা ঢের নিকৃষ্ট ধরনের কাগজ হয়েছে। শনিবারের চিঠি আর যা-ই হোক sincere—ওরা যা বলে তা ওরা নিজেরা বিশ্বাস করে। কিন্তু হসন্তিকার এই গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসার প্রবৃত্তিটা অতি জঘন্য। কিছু না বুঝে এলোপাথাড়ি বাজে সমালোচনা–কতখানি মানসিক অধঃপতন হলে যে এ সম্ভব জানিনে। তার ওপর, আগাগোড়া ওদের patronising attitudeটাই সব চেয়ে অসহ। আমাদের যেন অত্যন্ত কৃপার চোখে দেখে! এর চেয়ে শনিবারের চিঠির sworn enmity অনেক ভালো অনেক সুসহ।
হাসির কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে যায় দাঠাকুরকে। দা-ঠাকুর মানে শরৎ পণ্ডিত মশাই। যিনি কলকাতাকে ‘কেবল ভুলে ভরা’ দেখেছেন—সঙ্গে-সঙ্গে হয়তো জগৎ-সংসারকেও। নিমতলার ঘাটে নিমগাছটার কথা যিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন অবিরত। মাঝে-মধ্যে আসতেন কল্লোলের দোকানে। কথার পিঠে কথা বলার অপূর্ব দক্ষতা ছিল, আর সে সব কথার চাতুরী যেমন মাধুরীও তেমনি। তার হাসির নিচে একটি প্রচ্ছন্নদর্শন বেদনা ছিল। যে-বেদনা জন্ম নেয় পরিচ্ছন্ন দর্শনে। খালি গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে আসতেন। প্রচণ্ড শীত, খালি গায়ের উপরে তেমনি একখানি পাতলা চাদর দা-ঠাকুরের। কে যেন জিগগেস করল আশ্চর্য হয়ে, এই একটা সামান্য চাদরে শীত মানে? ট্যাঁক থেকে একটা পয়সা বার করলেন দা-ঠাকুর, বললেন, পয়সার গরম!