Feb. 14th, 1925.
H. G. Wells.
পৃথিবীর প্রায় সমস্ত মান্য-বরেণ্যকেই অভিনন্দন জানানো হয়েছিল। উপরি-উক্তরা ছাড়া অবশিষ্টগণ কেউ হয়ত পাননি চিঠি, কেউ হয়ত বা উপেক্ষা করলেন। কিন্তু সব চেয়ে প্রাণস্পর্শ করল ইয়োন নোগুচি। সোজাসুজি কবিতা পাঠিয়ে দিলে একটা। হৃদয়ের ব্যাকুলতার উত্তরে
হৃদয়ের গভীরতা। কবিতাটি ইংরিজিতে লেখা–মূল না অনুবাদ বোঝবার উপায় নেই, কিন্তু কবিতাটি অপরূপ।
I followed the Twilight :
I followed the twilight to find where it wont–
It was lost in the days full light.
I followed the twilight to find where it went–
It was lost in the dark of night.
Last night I wept in & passion of joy
To-night the passion of sorrow came.
O light and darkness, sorrow and joy,
Tell me, are ye the same?
Yone Noguchi.
কালিদাস নাগ কল্লোলের জ্যেষ্ঠতুল্য ছিলেন—শুধু গোকুলের অগ্রজ হবার সম্পর্কেই নয়, নিজের স্নেহবলিষ্ঠ অভিভাবকত্বের গুণে। অনেক বিপদে নিজে বুক এগিয়ে দিয়েছেন। যখনই নৌকো ঘূর্ণির মধ্যে পড়েছে, হাল তুলে নিয়েছেন নিজের হাতে। ঘোরালো মেঘকে কি করে হাওয়া করে দিতে হয় শিখিয়ে দিয়েছেন সেই মধুমন্ত্র। দুঃখের মধ্যে নিজে মানুষ হয়েছেন বলে শিখিয়ে দিয়েছেন সেই কৃচ্ছ্রাতিকৃচ্ছ্র, বাধাকে বশীভূত করার তপঃপ্রতাপ। নিজে লেখনী ধরেছেন কল্লোলের পৃষ্ঠায়—শুধু স্বনামে নয়, দীপঙ্করের ছদ্মনামে। দীপঙ্করের কবিতা দীপোজ্জলা।
সব চেয়ে বড় কাজ তিনি কল্লোলের দলকে প্রবাসীতে আসন করে দিলেন। সংকীর্ণ গিরিসঙ্কট থেকে নিয়ে গেলেন প্রশস্ত রাজপথে। তখনকার দিনে প্রবাসী বাংলা সাহিত্যের কুলীন পত্রিকা, তাতে জায়গা পাওয়া মানেই জাতে-ওঠা, সঙ্গে-সঙ্গে কিছু বা দক্ষিণার খুদকণা। আমাদের তখন কলা বেচার চেয়ে রথ দেখাই বড় কাম্য। কিন্তু দেখা গেল রথের বাহকরা আমাদের উপর ভারি খাপ্পা। কিন্তু কালিদাসবাবু দমলেন না—একেবারে রথের উপরে বসিয়ে ছাড়লেন।
ওদিকে সব চেয়ে জনপ্রিয় ছিল ভারতবর্ষ—কাটতির জনশ্রুতি পরিস্ফীত। আশাতীতরূপে সেখানে একদিন ডাক দিলেন জলধর সেন। সর্বকালের সর্ববয়সের চিরন্তন দাদা। অতি-আধুনিক সাহিত্যিক বলে কোনো ভীরু সংস্কার তো নেইই বরং যেখানে শক্তি দেখলেন সেখানেই স্বীকৃতিতে উদার-উচ্ছ্বল হয়ে উঠলেন। শুধু পত্রিকায় জায়গা করে দেয়া নয়, একেবারে হৃদয়ের মধ্যে নিয়ে আসা। মুঠো ভরে শুধু দক্ষিণা দেয়া নয়, হৃদয়ের দাক্ষিণ্য দেয়া। প্রণাম করতে গিয়েছি, দুহাত দিয়ে তুলে ধরে বুকের মধ্যে পিষে ধরেছেন। এ মামুলি কোলাকুলি নয়—এ আত্মার সঙ্গে আত্মার সম্ভাষণ। একজন রায়বাহাদুর, প্রখ্যাত এক পত্রিকার সম্পাদক, সর্বোপরি কৃতার্থম্মত সাহিত্যিক—অথচ অহঙ্কারের অবলেশ নেই। ছোট-বড় কৃতী-অকৃতী–সকলের প্রতি তার অপক্ষপাত পক্ষপাতিত্ব। বাংলা সাহিত্যের সংসারে একমাত্র জলধর সেনই অজাতশত্রু।
গ্রীষ্মের দুপুরে ভারতবর্ষের আপিসে খালি গায়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন, মুখে অর্ধদগ্ধ চুরুট, পাশে টেবল-ফ্যান চলছে—এই মূর্তিটিই বেশি করে মনে আসছে। তাকে চুরুট ছাড়া দেখেছি বলে মনে পড়ে না—আর সে চুরুট সর্বদাই অর্ধদগ্ধ। সম্পাদকের লেখা প্রত্যেকটি চিঠি তিনি স্বহস্তে জবাব দিতেন—আর সব চেয়ে আশ্চর্য, ছানিকাটানো চোখেও প্রুফ দেখতেন বর্জাইস টাইপের। কানে খাটো ছিলেন-সে শ্রবণাল্পতার নানারকম মজার গল্প প্রচলিত আছে–কিন্তু প্রাণে খাটো ছিলেন না। প্রাণে অপরিমেয় ছিলেন।
হয়তো গিয়ে বললাম, আমার গল্পটা পড়েছেন?
জলধরদাদা উত্তর দিলেন : কাল লালগোলায় গিয়েছিলুম।
কেমন লাগল গল্পটা?
হরিদাসবাবু? নিচেই আছেন–দেখলে না উঠে আসতে?
যদি টাকাটা—
ভারতবর্ষ? কাল বেরুবে।
চেঁচিয়ে বলছিলুম এতক্ষণ যাতে সহজে শোনেন। হঠাৎ গলা নামালুম, কণ্ঠস্বর ক্ষীণ করলুম, আর, আশ্চর্য, অমনি শুনতে পেলেন সহজে। খবর পেলুম গল্প পড়া ছাড়া ছাপা শেষ হয়ে গেছে। কাল কাগজ বেরুবে তা বেরোক, আজ যখন এসেছ আজকেই টাকাটা নিয়ে যাও।
জলধরের মতই শ্যামস্নিগ্ধ। বর্ষার জল শুধু সমুদ্র-নদীতেই পড়েনা, দরিদ্রের খানা-ডোবাতেও পড়ে। অকিঞ্চনতমও নিমন্ত্রণ করলে বয়সের শত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে জলধরাদাদা সর্বাগ্রে এসে উপস্থিত হয়েছেন–সে কসবাতেই হোক বা কাশীপুরেই হোক। মনে আছে, বেহালায়, ভবানী মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে রবিবারের সন্ধ্যায় জলধরদাদা এসেছেন। সেখানে হঠাৎ এক প্রতিবেশী ভদ্রলোক এসে উপস্থিত–জলধরদাদাকে মাস্টারমশাই সম্বোধন করে এক শ্রদ্ধাপ্লুত প্রণাম। কোন সুদূর অতীতে শিক্ষকতা করেছিলেন, তবু জলধরাদা প্রাক্তন ছাত্রকে চিনতে পারলেন। চিনতে পারল তাঁর চক্ষু তত নয় যত তাঁর প্রাণ। পরের বাড়িতে বসে ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না জলধরদাদা। তাই পরদিন আবার বেহালায় সেই ছাত্রের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন নিরিবিলি।
২০. কালি-কলম অফিসে পুলিশের হানা
আমাদের পূর্বাগতদের প্রায় সকলেই স্পর্শ পড়েছিল কল্লোলে। ভারতী দল বলতে যাদেরকে বোঝায় তাদেরই মুখপাত্রদের। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নরেন্দ্র দেব। বিখ্যাত বারোয়ারী উপন্যাসের গৌরবদীপ্ত পরিচ্ছেদ। সৌরীন্দ্রমোহন ও নরেন্দ্র দেব উপন্যাস লিখেছেন কল্লোলে, হেমেন্দ্রকুমার কবিতা আর প্রেমাঙ্কুর গল্প। পুরানো চালে ভাত বাড়ে তারই আকর্ষণে ও-সব ভাণ্ডারে মাঝে-মাঝে হাত পাততে দীনেশরঞ্জন, স্বজনপালনের খাতিরে ওঁরাও কার্পণ্য করতেন না, অবারিত হতেন। তবু কল্লোলে ওঁদের লেখা প্রকাশিত হলেও ওঁদের লেখায় কল্লোল প্রকাশিত হয়নি।