আভদয়িকের বৈঠক বসত বোজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। ভালো ঘব পাইনি কিন্তু ভালো সঙ্গ পেয়েছি এতেই সকল অভাব পুষিয়ে যেত। পাড়ায় প্রথম চিড় খেল প্রেমেন ঢাকায় চলে গেলে। সেখানে গিয়ে সে আদয়িকের শাখা খুললে, শুভেচ্ছা পাঠাল এখানকার আভ্যুদয়িকদিগের :
আভ্যুদয়িকগণ, আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
ঢাকায় এসেও আপনাদের ভুলতে পারছি না। আজ বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যায় সেই ছোট ঘরটিতে যখন জলসা জমে উঠবে তখন আমি এখানে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলব বই আর কি করব? ঢাকার আকাশ আজকাল সর্বদাই মেঘে ঢাকা, তবু কবিতার কলাপ বিকশিত হয়ে উঠছে না। আপনাদের আকাশের রূপ এখন কেমন? কোন কবির হৃদয় আজ উতলা হয়ে উঠেছে আপনাদের মাঝে, প্রথম শ্রাবণের কাজল-পিছল (দোহাই তোমার অচিন্ত্য, চুরিটা মাফ কোরো চোখের কটাক্ষে? কার বাদল-প্রিয়া এল মেঘলা আকাশের আড়াল দিয়ে হৃদয়ের গোপন অন্তঃপুরে, গোপন অভিসারে?
এখানে কিন্তু এ ভরা বাদর, মাহ—ভাদর নয়, শাঙন, শূন্য মন্দির মোর। কেউ আপনারা পারেন নাকি মন্দাক্রান্তা ছন্দে দুলিয়ে এই খাবণ-আকাশের পথে মেঘদূত পাঠাতে? কিন্তু ভুলে যাবেন না যেন যে আমি যক্ষপ্রিয়া নই।
দূর থেকে এই আদয়িকের নমস্কার গ্রহণ করুন। আর একবার বলি সেই প্রাচীন বৈদিক যুগের সুরে-সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সংবো মনাংসি জানতাম–
আমরা যে যেখানেই থাকি না, আমরা আভ্যুদয়িক।
এই সময়কার প্রেমেনের তিনখানা চিঠি—ঢাকা থেকে লেখা :
অচিন,
আজকালকার প্রেমের একটা গল্প শোন।
সে ছিল একটি মেয়ে, কিশোরী-তনু তার তনুলতা, চোখের কোণে চঞ্চলতাও ছিল, আর তাদের বাড়ীর ছিল দোতলা কিম্বা তেতলায় একটা ছাদ। অবশ্য লাগাও আর একটা ছাদও ছিল। মেয়েটির নাম অতি মিষ্টি কিছু ঠাউরে নে—ভাষায় বললে তার মাধুৰ্য্য নষ্ট হয়ে যাবে। কৈশোরের স্বপ্ন তার সমস্ত তনুবল্লরীকে জড়িয়ে আছে, ফুটন্ত হাহানায় চাঁদের আলোর মত। সে কাজ করে না, কিচ্ছু করে না-শুধু তার পিয়াসী আঁখি কোন সুদূরে কি খুঁজে বেড়ায়। একদিন ঠিক দুপুর বেলা, নোদ চড়চড় করছে অর্থাৎ রুদ্রের অগ্নিনেত্রের দৃষ্টির তলে পৃথিবী মুচ্ছিত হয়ে আছে—সে ভুল করে তার নীলাম্বরী শাড়ীখানি শুকোতে দিতে ছাদে উঠেছিল। হঠাৎ তার দূরাগত-পথ-চাওয়া আঁখির দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। ওগো জন্মজন্মান্তরের হৃদয়দেবতা, তোমায় পলকের সৃষ্টিতেই চিনেছি—এইরকম একটা ভাব। হৃদয়দেবতাও তখন লম্বা চুলে টেড়ি কাটছিলেন, সামনেই দেখলেন তীব্র জ্বালাময় আকাশের নীচে স্নিগ্ধ আষাঢ়ের পথহারা মেঘের মত কিশোরীটিকে। আর্শির রোদ ঘুরিয়ে ফেললেন তার মুখে তৎক্ষণাৎ। ওগো আললাকের দূত এলো তোমার হৃদয় হতে আমার হৃদয়ে। মেয়েটি একটু হাসলে যেন দূর মেঘের কোলে একটু শীর্ণ চিকুর খেলে গেল। প্রেম হল। কিন্তু পালা এইখানেই সাঙ্গ হল না। আলোকের দূত যাতায়াত করতে লাগল। লোষ্ট্ববাহন লিপিকা তারপর। একদিন লোষ্ট্ববাহন লিপিকা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে হৃদয়দেবতার স্কুল দেহের কপাল নামক অংশবিশেষকে আঘাত করে রক্ত বার করে দিলে ও কালশিরে পড়িয়ে দিলে। হৃদয়দেবতা লিখলেন, তোমার কাছ থেকে এ দান আমার চরম পুরস্কার। এই কালো দাগ আমার প্রিয়ার হাতের স্পর্শ, এ আমার জীবন পথের পাথেয়। ভোমার হাতে যা পাই তাইতেই আমার আনন্দ। অবশ্য প্রিয়ার হাতের স্পর্শ ও জীবন পথের পাথেয়র ওপর টিঙ্কচার আয়োডিন লাগাতে কোন দোষ নেই। জীবনদেবতা তাই লাগাতেন। এবং বাড়ীর লোক কারণ জিজ্ঞাসা কল্লে একটা অতি কাব্যগন্ধহীন স্কুল বিশ্রী মিথ্যা বলতে দ্বিধা করেন নি, যথা—খেলতে গিয়ে ইটে আছাড় খেয়েছি।
ওই পর্যন্ত লিখে নাইতে খেতে গেছলুম। আবার লিখছি। এখানে সাহিত্য জগতের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা রাখবার সুযোগ নেই। লেখা তো একেবারেই বন্ধ। My Muse is mute. কোন কালে আর সে মুখ খুলবে কিনা জানি না। মাথাটায় এখন ভারী গোলমাল। মাথা স্থির না হলে ভালো আর্ট বেরোয় না, কিন্তু আমার মাথায় ঘূর্ণি চলেছে। শরীর ভালো নয়। বিনয় আর রমেশের ঠিকানা জানি না, পাঠিয়ে দিস।
খানিক আগে কটা প্রজাপতি খেলছিল নীচের ঘাসের জমিটুকুর ওপর। আমার মনে হল পৃথিবীতে যা সৌন্দর্য প্রতি পলকে জাগছে, এ পর্যন্ত যত কবি ভাষার দোলনা দোলালে তারা তার সামান্যই ধরতে পেরেছে-অমৃত-সাগরের এক অঞ্জলি জল, কেউ বা এক ফোঁটা। আমরা সাধারণ মানুষ এই সৌন্দর্য্যের পাশ দিয়ে চলাচল করি, আর কেউ বা দাঁড়িয়ে এক অঞ্জলি তুলে নেয়। কিন্তু কিছুই হয়নি এখন। হয়ত এমন কাল আসছে যার কাব্যের কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। তারা এই মাটির গানই গাইবে, এই সবুজ ঘাসের এই মেঘলা দিনের কিম্বা এই ঝড়ের রাতের–কিন্তু যে সুক্ষ্মতম সুর যে পরম ব্যঞ্জনা আমরা ধরতেও পারি নি তারা তাকেই মূৰ্ত্ত করবে। আমি ভাবতে চেষ্টা কচ্ছি তখন নারীর ভেতর মানুষ কি খুঁজে পাবে। মানুষ দেহের আনন্দ নারীর ভেতর খুঁজতে খুঁজতে আজ এইখানে এসে দাঁড়িয়েছে—সেদিন যেখানে গিয়ে পৌঁছাবে তার আমরা কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু আছে সৃষ্টির অন্তরে অনন্ত অমৃতের পথ-তার কোথায় আজ আমরা? চাই অমৃতের জন্যে তপস্যা। মানুষ ড্রেডনটই তৈরী করুক আর ওয়ারলেসই চালাক এ শুধু বাইরের–ভেতরের সাধনা তার অমৃতের জন্যে।
কিন্তু আসল কথা কি জানিস অচিন, ভালো লাগে না—সত্যি ভালো লাগে না। বন্ধুর প্রেমে আনন্দ নেই, নারীর মুখেও আনন্দ নেই, নিখিল বিশ্বে প্রাণের সমারোহ চলেছে তাতেও পাই না কোনো আনন্দ। কিন্তু একদিন বোধ হয় পৃথিবীর আনসভায় আমার আসন ছিল—অন্ধকার রাত্রে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে আকাশের পানে চাইলে মনে হত, সমস্ত দেহ-মন যেন নক্ষত্রলোকের অভিনন্দন পান করছেঅপরূপ তার ভাষা। বুঝতে পারতুম আমার দেহের মধ্যে অমনি অপূৰ্ব রহস্য অনাদি অনন্ত আকাশের ভাষায় সাড়া দিচ্ছে। আজকাল মাঝে মাঝে জোর করেই সেই আসনটুকু অধিকার করতে যাই কিন্তু বৃথাই। ভালো লাগে না, ভালো লাগে না। আশ্চর্য হয়েই ভাবি এই দেহটার মাল মশলা সবই প্রায় তেমনি আছে। হৃৎপিণ্ড তেমনই নাচছে, শিরায় শিরায় রক্ত ছুটছে, ফুসফুস থেকে নিংড়ে নিংড়ে রক্ত বেরুচ্ছে। খাড়া হয়ে হাঁটি, গলা থেকে তেমনি স্বর বেরোয়। এই সেই দেবতার দেহটা এমন হল কেন? আর সে বাজে না। নিখিল-দেবতার এই যে দেহ সে নিখিল-দেবতাকেই এমন করে ব্যঙ্গ করে কেন?.. এখানে ধারাবণ, কিন্তু শ্রাবণ-ধন-গহন মোহে কারুর গোপন চরণ-ফেলা টের পাই না। বৃষ্টিতে দেশ ভেসে গেল কিন্তু আমার প্রাণে তার দৃষ্টি পড়ল না। কেবল শুকনো তৃষ্ণার্ত মাটি—নিস্পন্দ নির্জীব। বর্ষার নৃত্যসভার গান শোনবার জন্যে দেখছি মাটি পাথর মরু ফুড়ে কোণে-কোণে আনাচে-কানাচে পৃথিবীর স্থানে-অস্থানে নব নব প্রাণ মাথা তুলে উঁকি মারছে, কিন্তু আমার জীবনের নবাঙ্কুর শুকিয়ে মরে আছে। আমার মাটি সরস হল না। সেদিন রাত্রে শ্রাবণের সারঙে একটা সুর বাজছিল, সুরটা আমার বহুদিনকার পরিচিত। ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম, আশা হচ্ছিল হয়ত পুরোনো বর্ষারাত্রির আনন্দকে ফিরে পাব। কিন্তু হায়, বৃষ্টি শুধু, বৃষ্টি, অন্ধকার আকাশ শুধু অন্ধকার আকাশ। এই বৃষ্টি পড়াকে ব্যাখ্যা করতে পারি অনুভব করতে পারি ইন্দ্রিয় দিয়ে কিন্তু অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি না। তাই মেঘের জল শুধু ঝরতে লাগল, আমার হৃদয় সাড়া দিলে না।