কাল এখানে চমৎকার জ্যোৎস্নারাত ছিল। সে বর্ণনা করা যায় না। মনের মধ্যে সে একটা অনুভূতি শুধু। ভগবানের বীণায় নব নব সুর বাজছে—কালকের জ্যোৎস্নারাতের সুর বাজছিল আমার প্রাণের তারে, তার সাড়া পাচ্ছিলুম। তারাগুলো আকাশে ঠিক মনে হচ্ছিল সুরের ফিনকি আর পথটা তন্দ্রা, পাতলা তন্দ্রা, আকাশটা স্বপ্ন। এক মুহূর্তে মনের ভেতর দিয়ে সুরের ঝিলিক হেনে দিয়ে গেল, বুঝলুম, ভয় মিথ্যা। হতাশা মিথ্যা মৃত্যু মিথ্যা। কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে হবে, প্রমাণ। করতে হবে আমার জীবন দিয়ে। বলেছিলুম প্রিয়া অচেনা, আজ দেখছি আমি যে আমার অচেনা। প্রিয়া যে আমিই। এক অচেনা দেহে, আর এক অচেনা দেহের বাইরে। স্কুল জগতে একদিন আদিপ্রাণ protoplasm-নিজেকে দুভাগ করেছিল। সেই দুভাগই যে আমরা। আমরা কি ভিন্ন? আমি পৃথিবী, প্রিয়া আকাশ—আমরা যে এক। এই এককে আমায় চিনতে হবে আমার নিজের মাঝে আর তার মাঝে। এই চেনার সাধনা অন্তহীন তপস্যা হচ্ছে মানুষের। সেই চেনার কি আর শেষ আছে? একদিন জানতুম আমি রক্তমাংসের মানুষ, ক্ষুধাতৃষ্ণাভরা আর প্রিয়া দেহসুখের উপাদান—তারপর চিনছি আর চিনছি। আজ চিনতে চিনতে কোথায় এসে পৌঁছেছি, তবু কি আনন্দের শেষ আছে। আমার আমি কি অপরূপ, কি বিস্ময়কর! এই চেনার পথে কত রৌদ্র কত ছায়া কত ঝড় কত বৃষ্টি কত সমুদ্র কত নদী কত পর্বত কত অরণ্য কত বাধা কত বিঘ্ন কত বিপথ কত অপথ।
থামিসনি কোনোদিন থামিসনি। থামব না আমরা, কিছুতেই না। ভয় মানে থামা হতাশা মানে থামা অবিশ্বাস মানে থামা ক্ষুদ্র বিশ্বাস মানেও থামা। দেহের ডিঙা যদি তুফানে ভেঙে যায় খুঁড়িয়ে যায়, গেল তো গেল-হালের কাছে মাঝি আছে। যৌবনটা হচ্ছে রাত্রি, তখন আমার পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে যায়, শুধু থাকে প্রিয়ার আকাশযেটুকু আলো পড়ে, কখনো তারা কখনো জ্যোৎস্নার, আমার পৃথিবীর ওপর শুধু সেইটুকু। তোর সেই জীবনের রাত্রি এসেছে, কিন্তু এসেছে ঘোর ঘনঘটা করে, নিবিড় অন্ধকার করে—তা হোক, বিচিত্র পৃথিবী। বিচিত্র জীবনের কাহিনী। শুধু মনের মধ্যে মন্ত্র হোক-উডিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত। যদি কেউ ঐশ্বর্য নিয়ে সুখী হয় হোক, ক্ষুদ্র শাস্তি নিয়ে সুখী হয় হতে দাও, আমরা জানি ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি। অতএব ভূমৈব জিজ্ঞাসিতব্য। সেই ভূমার খোঁজে যেন আমরা না নিরস্ত হই। আর যৌবনকে বলি, বয়সের এই মায়াজালের। বাঁধনখানা তোরে হবে খণ্ডিতে।
এর কদিন পরেই আরেকটা চিঠি এল প্রেমেনের সেই মধুপুর থেকে :
হ্যাঁ, আরেকটা খবর আছে। এখানে এসে একটা কবিতার শেষ পূরণ করেছি আর চারটে নতুন কবিতা লিখেছি। তোকে দেখাতে ইচ্ছে করছে। শেষেরটার আরম্ভ হচ্ছে নমো নমো নমো। মনের মধ্যে একটা বিরাট ভাবের উদয় হয়েছিল, কিন্তু সব ভাষা ওই গুরুগভীর নমো নমো নমো-র মধ্যে এমন একাকার হয়ে গেল যে কবিতাটা বাড়তেই পেল না। কবিতার সমস্ত কথা ওই নমো নমো নামো-র মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে রইল। কি রকম কবিতা লিখছিস?
০৩. বন্ধু দুটির নাম শিশিরচন্দ্র বসু আর বিনয় চক্রবর্তী
তেরোশ একত্রিশ সালের পয়লা জ্যৈষ্ঠ আমি প্রেমেন আর আমাদের। দুটি সাহিত্যিক বন্ধু মিলে একটা সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করলাম। তার নাম হল আভ্যুদয়িক। আর বন্ধু দুটির নাম শিশিরচন্দ্র বসু আর বিনয় চক্রবর্তী।
যেমনটি সাধারণত হয়ে থাকে। অভিভাবক ছাড়া আলাদা একটা ঘরে জন কয়েক বন্ধু মিলে মনের সুখে সাহিত্যিকগিরির আখড়াই দেওয়া। সেই গল্প-কবিতা পড়া, সেই পরস্পরের পিঠ চুলকোনো। সেই চা, সিগারেট, আর সর্বশেষে একটা মাসিক পত্রিকা ছাপাবার রঙিন জল্পনাকল্পনা। আর, সেই মাসিক পত্রিকা যে কী নিদারুণ বেগে চলবে মুখে মুখে তার নির্ভুল হিসেব করে ফেলা। অর্থাৎ দুয়ে-দুয়ে চার না করে বাইশ করে ফেলা।
তখনকার দিনে আমাদের এই চারজনের বন্ধুত্ব একটা দেখবার মত জিনিস ছিল। বোজ সন্ধ্যায় একসঙ্গে বেড়াতে যেতাম হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা উডবান পার্কে, নয়তো মিন্টো স্কোয়ারে মালীকে চার আনা পয়সা দিয়ে নৌকা বাইতাম। কোনো দিন বা চলে যেতাম প্রিনসেপ ঘাট, নয়তো ইডেন গার্ডেন। একবার মনে আছে, স্টিমারে করে রাজগঞ্জে গিয়ে, সেখান থেকে আন্দুল পর্যন্ত পায়ে হাঁটা প্রতিযোগিতা করেছিলাম চারজন। আমাদের দলে তখন মাঝে-মাঝে আরো একটি ছেলে আসত। তার নাম রমেশচন্দ্র দাস। কালে ভদ্রে আরো একজন। তার নাম সুনির্মল বসু। বলিয়া গেছেন তাই মহাকবি মাইকেল, যেওনা যেওনা সেথা যেথা চলে সাইকেল। মনোহরণ শিশু-কবিতা লিখে এরি মধ্যে সে বনেদী পত্রিকায় প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে।
শিশির আর বিনয়ের সাহিত্যে বিশেষ প্রতিশ্রুতি ছিল। বিনয়ের কটি ছোট গল্প বেরিয়েছিল ভারতীতে, তাতে দস্তুরমতো ভালো লেখকের স্বাক্ষর আঁকা। শিশির বেশির ভাগ লিখত মৌচাকে, তাতেও ছিল নতুন কোণ থেকে দেখবার উঁকিঝুকি। আমরা চার জন মিলে একটা সংযুক্ত উপন্যাসও আরম্ভ করেছিলাম। নাম হয়েছিল চতুষ্কোণ। অবিশ্যি সেটা শেষ হয় নি, শিশির আর বিনয় কখন কোন ফাঁকে কেটে পড়ল কে জানে। সেই একত্র উপন্যাস লেখার পরিকল্পনাটা আমি আর প্রেমে পরে সম্পূর্ণ করলাম আমাদের প্রথম বই বাঁকালেখা। জীবনের লেখা যে লেখে সে সোজা লিখতে শেখেনি এই ছিল সেই বইয়ের মূল কথা।