ম্যাট্রিক পরীক্ষায় আমি আর প্ৰেমেন দুজনেই মান রেখেছিলাম পণ্ডিত মশাইর। দুজনেই ভি পেয়েছিলাম।
রাস্তায় এক দিন দেখা পণ্ডিত মশাইর সঙ্গে। কাঁধ চাপড়ে বললেন, আমার মান কিন্তু আরো উঁচু। নি-পূৰ্ব্বক স্থা ধাতু অ-কতৃর্বাচ্যে। মনে থাকে যেন।
তাঁর কথাটা মনে রেখেছি কিনা আমাদের অগোচরে তিনি লক্ষ্য করে এসেছেন বরাবর। শুনেছি পরবর্তী কালে প্রতি বৎসর নবাগত ছাত্রদের উদ্দেশ করে স্নেহ-গগদ কণ্ঠে বলেছেন—এইখানে বসত প্রেমেন আর ঐখানে অচিন্ত্য।
ম্যাট্রিক পাশ করে প্রেমেন চলে গেল কলকাতায় পড়তে, আমি ভর্তি হলাম ভবানীপুরে। সে সব দিনে ধর্মতলা পেরিয়ে উত্তরে গেলেই ভবানীপুরের লোকেরা তাকে কলকাতায় যাওয়া বলত। হয়তো ঘুরে এলাম ঝামাপুকুর বা বড়বাগান থেকে, কেউ জিগগেস করলে বলতাম কলকাতায় গিয়েছিলাম।
নন-কোঅপারেশনের বান-ডাকা দিন। আমাদের কলেজের দোতলার বারান্দা থেকে দেশবন্ধুর বাড়ির আঙিনা দেখা যায়—শুধু এক দেয়ালের ব্যবধান। মহাত্মা আছেন, মহম্মদ আলি আছেন, বিপিন পালও আছেন বোধ হয়-তরঙ্গতাড়নে কলেজ প্রায় টলোমলো। কি ধরে যে আঁকড়ে থাকলাম কে জানে, শুনলাম প্রেমেন ভেসে পড়েছে।
ডাঙা পেল প্রায় এক বছর মাটি করে। এবার ভালো ছেলের মত কলকাতায় না গিয়ে ঢুকল পাড়ার কলেজে। সকাল-বিকেলের সঙ্গীকে দুপুরেও পেলাম এবার কাছাকাছি। কিন্তু পরীক্ষার কাছাকাছি হতেই বললে, কী হবে পরীক্ষা দিয়ে। ঢাকায় যাব।
১৯২২-সালে পুরী থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্রর চিঠি :
দুঃখের তপস্যায় সবই অমৃত, পথেও অমৃত, শেষে ও অমৃত। সফল হও ভালই, না হও ভালই। আসল কথা সফল হওয়া না-হওয়া নেই—তপস্যা আছে কিনা সেইটেই আসল কথা। সৃষ্টি তত স্থিতির খেয়ালে তৈরী নয়, গতির খেয়ালে। যা পেলুম তাও অহরহ সাধনা দিয়ে রাখতে হয়, নইলে ফেলে যেতে হয়। এখানে কেউ পায় না, পেতে থাকে—সেই পেতে-থাকার অবিরাম তপস্যা করছি কিনা তাই নিয়ে কথা। যাকে পেতে থাকি না সে নেই।…যা পাই তাও ফেলে যাই, গাছ যেই ফুল পায় অমনি ফেলে দিয়ে যায়, তেমনি আবার ফল ফেলে দিয়ে যায় পাওয়া হলেই।…যারা পায় তাদের মতো হতভাগা আর নেই। দুঃখের ভয়ে যারা কঠিন তপস্যা থেকে বিরত হয়ে সহজ পথ খোঁজে আরামের, তাদের আরামই জোটে, আনন্দ নয়।…
আমি পড়াশুনা একদিনও করিনি—পারা যায় না। আমার মত লোকের পক্ষে পড়ব বল্লেই পড়া অসম্ভব। হয়ত এবার একজামিন দেওয়া হবে না।
তোর প্রেমেন্দ্র মিত্র
পুরী থেকে লেখা আরেকটা চিঠির টুকরো—সেই ১৯২২-এ :
সমুদ্রে খুব নাইছি। মাঝে-মাঝে এই প্রাচীন পুরাতন বৃদ্ধ সমুদ্র আমাদের অর্বাচীনতায় চটে গিয়ে একটু আধটু ঝাঁকানি কানমলা দিয়ে দেন—নইলে বেশ নিরীহ দাদামশাইয়ের মত আনমনা!
ঝিনুক কুড়োচ্ছি। পড়াশোনা মোটেই হচ্ছে না—তা কি হয়?
সে-সব দিনে দুজন লেখক আমাদের অভিভূত করেছিল-গল্পেউপন্যাসে মণীন্দ্রলাল বসু আর কবিতায় সুধীরকুমার চৌধুরী। কাউকে তখনো চোখে দেখিনি, এবং এদেরকে সত্যি-সত্যি চোখে দেখা যায় এও যেন প্রায় অবিশ্বাস্য ছিল। কলেজের এক ছাত্র-নাম হয়তো। উষারঞ্জন রায়—আমাদের হঠাৎ একদিন বিষম চমকে দিলে। বলে কিনা, সে সুধীর চৌধুরীর বাড়িতে থাকে, আর, শুধু এক বাড়িতেই নয়, একই ঘরে, পাশাপাশি তক্তপোশে! যদি যাই তো দুপুরবেলা সেই ঘরে ঢুকে বাক্স ঘেটে সুধীর চৌধুরীর কবিতার খাতা আমরা দেখে আসতে পারি।
বিনাবাক্যব্যয়ে দুজনে রওনা হলাম দুপুরবেলা। সুধীর চৌধুরী তখন রমেশ মিত্র রোডে এক একতলা বাড়িতে থাকেন—তখন হয়তো রাস্তার নাম পাকাপাকি রমেশ মিত্র রোড হয়নি—আমরা তার ঘরে ঢুকে তার ডালা-খোলা বাক্স হাটকে কবিতার খাতা বার করলাম। ছাপার অক্ষরে যার কবিতা পড়ি স্বহস্তাক্ষরে তাঁর কবিতা দেখব তার স্বাদটা শুধু তীব্রতর নয়, মহত্তর মনে হল। হাতাহাতি করে অনেকগুলি খাতা থেকে অনেকগুলি কবিতা পড়ে ফেললাম দুজনে। একটা কবিতা ছিল বিদ্রোহী বলে। বোধ হয় নজরুল ইসলামের পালটা জবাব। একটা লাইন এখনও মনে আছে—আমার বিদ্রোহ হবে প্রণামের মত। গভীর উপলব্ধি ও নিঃশেষ আত্মনিবেদনের মধ্যেও যে বিদ্রোহ থাকতে পারে—তারই শান্ত স্বীকৃতির মত কথাটা।
কবিতার চেয়েও বেশি মুগ্ধ করল কবিতার খাতাগুলির চেহারা। ষোলপেজী ডবল ডিমাই সাইজের বইয়ের মত দেখতে। মনে আছে পরদিনই দুইজনে ঐ আকৃতির খাতা কিনে ফেললাম।
১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে বটতলা বাড়ি, পাথরচাপতি, মধুপুর থেকে প্রেমেন আমাকে যে চিঠি লেখে তা এই :
অচিন, তবু মনে হয় আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। তারা মিথ্যা বলেনি সেই সত্যের সাধকেরা, ঋষিরা। আনন্দে পৃথিবীর গায়ে প্রাণের রোমাঞ্চ হচ্ছে, আনন্দে মৃত্যু হচ্ছে, আনন্দে কান্না আনন্দে আঘাত সইছে নিখিলভুবন। নিখিলের সত্য হচ্ছে চলা, প্রাণ হচ্ছে দুরন্ত নদী-সে অস্থির, সে আপনার আনন্দের বেগে অস্থির। আনন্দভরে সে স্থির থাকতে পারে না—প্রথম প্রেমের স্বাদ পাওয়া কিশোরী। সে আঘাত যেচে খেয়ে নিজের আনন্দকে অনুভব করে। ভগবানও ওই আনন্দভরে স্থির থাকতে পারেননি, তাই সেই বিরাট আনন্দময় নিখিলভুবনে নেচে কুঁদে খেলায় মেতেছেন। সে কি দুরন্তপনা! অবাধ্য শিশুর দুরন্তপনায় তারই আভাস।
মানুষ যে বড় বড়, সে যে ধারণাতীত—সে যে সুধীর চৌধুরী যা বলতে গিয়ে বলতে না পেরে বলে ফেলে—ভয়ঙ্কর—তাই। তাই তার সব ভয়ঙ্কর, তার আনন্দ ভয়ঙ্কর, তার দুঃখ ভয়ঙ্কর, তার ত্যাগ ভয়ঙ্কর, তার অহঙ্কার ভয়ঙ্কর, তার স্থলন ভয়ঙ্কর, তার সাধনা, ভয়ঙ্কর। তাই একবার বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যাই যখন তার সাধনার দিকে তাকাই, তার আনন্দের দিকে তাকাই। আবার ভয়ে বুক দমে যায় যখন তার দুঃখের দিকে তাকাই, তার স্থানের দিকে তাকাই। আর শেষকালে কিছু বুঝতে না পেরে বলি—ধন্য ধন্য ধন্য।