কিন্তু যদি আকাশভরা সোনার রোদ থাকে, মাঠ শুকনো খটখটে, তবে সব কষ্ট সহ্য করবার দায়ধারী আছি। আর সে গগনলন গ্রীষের কষ্টই কি কম। তারপর যদি দুপুর থেকে বসে থেকে মাথার রোদ ক্রমে-ক্রমে মুখের উপর তুলে আনতে হয়। কিন্তু, খবর, ভুলেও জল চেও না, জল চাইতে না মেঘ এসে উদয় হয়! যা দেবী সর্বভূতেষু তৃষ্ণারূপেন সংস্থিতা তার ধ্যান কব। বরফের টুকরো বা কাটা শশা। বা বাতাবিনেবু না জোটে তো শুকনো চীনেবাদাম খাও। আর যদি ইচ্ছে করো আলগোছে কারে শূন্য পকেটে শুকনো খোমলো চালান করে দিয়ে বকধার্মিক সাজো।
যেমনি দুই দিক থেকে দুই দল শূন্তে বল হাই কিক মেয়ে মাঠে নামল অমনি এক ইঙ্গিতে সবাই উঠে দাঁড়াল গ্যালারিতে। এই গ্যালারিতে উঠে দাঁড়ানো নিয়ে বন্ধুবর শচীন করকে একবার কোন সাপ্তাহিকে আক্ষেপ করতে দেখেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে তার বক্তব্য ছিল এই, যে, গ্যালারিতে যে যার জায়গাই বসেই তো দিব্যি খেলা দেখা যায়, তবে মিছিমিছি কেন উঠে দাঁড়ানো? ধু যে যোগ্য উত্তেজনা দেখানোর তাগিদেই উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে তা নয়, উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে আট আনার চেয়ার ও চার আনার গ্যালারির মধ্যেকার জায়গায় লোক দাঁড়িয়েছে বলে। বাধ্য হয়েই তাই গ্যালারির প্রথম ধাপের লোককে দাঁড়াতে হচ্ছে এবং তার ফলে একে-একে অন্যান্য ধাপ। তাছাড়া বসে বসে বড় জোর হাততালি দেওয়ার মত খেলা তো এ নয়। উঠে দাঁড়াতেই হবে তোমাকে, অন্তত মোহনবাগান যখন গোল দিয়েছে। কখনো-কখনো সে চীৎকার নাকি বালি থেকে বালিগঞ্জ পর্যন্ত শোনা গেছে। সে চীৎকার কি বসে-বসে হয়?
তবু এত করেও কি প্রত্যেক খরার দিনেই জেতাতে পেরেছি মোহনবাগানকে? একেবারে ঠিক চূড়ান্ত মুহূর্তে অত্যন্ত অনাবশ্যক ভাবে হেরে গিয়েছে দুর্বলতর দলের কাছে। কুমোরটুলি এরিয়ান্স হাওড়া ইউনিয়নের কাছে। ঠিক পারের কাছে নিয়ে এসে বানচাল করে দিয়েছে নৌকো। সে সব দুর্দৈবের কথা ভাবতে আজো নিজের জয়ে দুঃখ হয়—সেই ঝেড়ো কাক হয়ে ম্লান মুখে বাড়ি ফিরে যাওয়া। চলায় শক্তি নেই, রেস্তরাঁয় ভক্তি নেই—এত সাধের চীনেবাদামে পর্যন্ত বাদ পাচ্ছি না—সে কি শোচনীয় অবস্থা! ওয়ালফোর্ডের হাদ-খোলা দোতলা বাস-এ সান্ধ্যভ্রমণ তখন একটা বিলাসিতা, তাতে পর্যন্ত মন ওঠে না, ইচ্ছে করে ট্রামের সেকেণ্ড ক্লাশে উঠে মুখ লুকোই। কে একজন যে মোহনবাগানের হেরে যাওয়ায় আত্মহত্যা করেছিল তার মর্মবেদনাটা যেন কতক বুঝতে পারি। তথনই এতিয়া করি আর যাব না ঐ অভাগ্যের এলাকায়। কিন্তু হঠাৎ আবার কোন সুদিনে সমস্ত সংকল্প পিটটান দেয়। আবার একদিন পাঞ্জাবির, ঘড়ির পকেটে গুনে-গুনে পয়সা গুঁজি। বুঝতে পারি মোহনবাগান যত না টানে, টানে সেন্টারের কাছাকাছি সেই কল্লোলের দল।
আচ্ছা, এরিয়ান্স হাওড়া ইউনিয়ন—এরাও তো দিশি টিম, তবে এরা জিতলে খুশি হই না কেন, কেন মনে-মনে আশা করি এরা মোহনবাগানকে ভালবেসে গোল ছেড়ে দেবে, আর গোল ছেড়ে না দিলে কেন চটে যাই? যখন এরা সাহেব টিমের সঙ্গে খেলছে তখন অবিশ্যি আছি আমরা এদের পিছনে, কিন্তু মোহনবাগানের সঙ্গে খেলতে এসেছ কি খবরদার, জিততে পাবে না, লক্ষ্মী ছেলের মত লাড্ড, খেয়ে বাড়ি ফিরে যাও। মোহনবাগানের ঐতিহ্যকে নষ্ট কোনো না যেন।
রোজ-বোজ খেলা দেখার ভিড় ঠেলার চেয়ে মোহনবাগানের মেম্বর হয়ে যাওয়া মন্দ কি। কিন্তু মেম্বর হয়েও যে কি দুর্ভোগ হতে পারে তারও দৃষ্টান্ত দেখলাম। একদিন কি একটা খবরের কাগজের শুম্ভকাপানো বিখ্যাত খেলায় দেখতে পেলাম তিন-চারজন মেম্বর মাঠে না ঢুকে বাইরে বসে সিগারেট ফুকছে, তাদের ঘিরে ছোট্ট একটি ভিড়। বিশ্বসাতীত ব্যাপার-ভিতরে ঐ চিত্ত-চমকানো খেলা, আকাশঝলসানো চীৎকার—অথচ এ কয়জন জাদরেল মেম্বর বাইরে ঘাসের উপর বসে নির্লিপ্ত মুখে সিগারেট খাচ্ছে আর মন্দ মন্দ পা দোলাচ্ছে। ভিড়ের থেকে একজন এগিয়ে গিয়ে বিস্মিত স্বরে জিগগেস করলে, এ কি, আপনারা মাঠে ঢোকেন নি যে? ভদ্রলোকের মধ্যে একজন বললে: আমরা তো কেউ মাঠে ঢুকি না, বাইরেই বসে থাকি চিরদিন। আমরা non-seeing মেম্বর। তার মানে? তার মানে, আমরা অপয়া, অনামুখো, অলক্ষুনে, আমরা মাঠে ঢুকলেই মোহনবাগান নির্ঘাৎ হেরে যায়, মেম্বর হয়েও আমরা তাই খেলা দেখি না, বাইরে বসে যাতে ঘাস কাটি আর চীৎকার শুনি।
এই অপূর্ব স্বার্থশূন্যতার কথা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার যোগ্য। বাড়িতে বা অন্য কোথাও গেলে বা বসে থাকলে চলবে না, খেলার মাঠে আসতে হবে ঠিক, আর খেলার মাঠে অনায়াসে ঢোকবার হকদার হয়েও ঢুকবে না কিছুতেই, বাইরে বসে থাকবে এককোণে—এমন আত্মত্যাগের কথা এ যুগের ইতিহাসে বড় বেশি শোনা যায়নি। আবো একটা উদাহরণ দেখেছি স্বচক্ষে একটি খঞ্জ ভদ্রলোকের মাধ্যমে। কি হল, পা গেল কি করে? গাড়ি-চাপ? ভদ্রলোক কঠিন মুখে করুণ ভাবে হাসলেন। বললেন, না। ফুটবল-চাপা। সে কি কথা? আর কথা নয়, কাজ ঠিক আদায় করে নিয়েছেন ষোল আনা। শুধু আপনাকে বলছি না, দেশের লোককে বলছি। সবাই বলেছিলেন ফুটবল মাঠে পা-খানা রেখে আসতে, আপনাদের কথা শুনে তাই রেখে এসেছি। কই এখন সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখবেন না যাদুঘরে?
১১. ফুটবল খেলার মাঠে শিবরাম চক্রবর্তী ও বিশ্বপতি চৌধুরী
ফুটবল খেলার মাঠে দুজন সাহিত্যিককে আমরা আবিষ্কার করি। শিবরাম চক্রবর্তী সেন্টারের কাছে গ্যালারির প্রথম ধাপে ধাড়াতোকে টেনে আনতে দেরি হত না আমাদের দশচক্রে গোলগাল নধরকান্তি চেহারা, লম্বা চুল পিছনের দিকে ওলটানো। সমস্তটা উপস্থিতি রসে-হাশ্যে সমুজ্জল। তার মধ্যে শ্লেষ আছে কিন্তু দ্বেষ নেইসে সরসতা সরলতারই অন্য নাম। ভারতীতে অদ্ভুত কত গুলো ছোট গল্প লিখে অস্বাভাবিক খ্যাতি অর্জন করেছে, আর তার কবিতাও স্পষ্টস্পর্শ প্রেমের কবিতা—আর সে-প্রেম একটু জরো হলেও জল-বার্তিখাওয়া প্রেম নয়। শিবরামের সত্যিকারের আবির্ভাব হয় তার একান্ত নাটিকায়—যেদিন তারা কথা বলবে আজকালকার গণসাহিত্যের নিতুল পূর্বগামী। সেই স্তব্ধতার দেশে বেশি দিন না থেকে শিবরাম চলে এল উল-উচ্ছল মুখরতার দেশে। কলহাস্যের মুখরতা। শিবরাম হাসির গল্পে কায়েমী বাসা বাঁধলে। বাসা যেমন পাকা, স্বত্ব তেমনি উঁচুদরের।