কল্লোলের লাগোয়া পূবের বাড়িতে থাকত আমাদের সুধীনসুধীন্দ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠ তরুণ উৎসাহী। সুগৌর-সুন্দর চেহারা, সকলের স্নেহভাজন। দলপতি স্বয়ং দীনেশ। যৌবনের সেই যৌবরাজ্যে বয়সের কোনো ব্যবধান ছিল না, আর মোহনবাগানের খেলা এমন এক ব্যাপার যেখানে ছেলে-বুড়ো শ্বশুরজামাই সব একাকার, সকলের এক দূরে মাথা মোড়ানো। অতি উৎসাহে সামনে কারু পিঠে হয়তো চাপড় দিয়েছি, ভদ্রলোক ঘড় ফেরাতেই চেয়ে দেখি পূজ্যপাদ প্রফেসর। উপায় নেই, সব এখন এক সানকির ইয়ার মশাই, এক গ্যালারির গায়েক-গায়েন। আরো একটু টানুন কথাটা, এক সুখদুঃখের সমাংশভাগী! তাই, ঐ দেখুন খেলা, বেশিক্ষণ ঘাড় ফিরিয়ে চোখ গোল করে পেছনে তাকিয়ে থাকার কোন মানে হয় না। বলা বাহুল্য, উত্তেজনার তরলে ঐ সব ছোটখাট রাগ-দুঃখের কথা ভুলে যেতে হয়, আর দর্শকদের বহু জন্মের সুকৃতির ফলে মোহনবাগান যদি একবার গোল দেয়, তখন সেই পূজ্যপাদ প্রফেসরও হাত-পা ছুড়ে চীৎকার করেন আর ছাত্রের গলা ধরে আনন্দ-মহাসমুদ্রে হাবুবু খান। সব আবার এক খেয়ার জল হয়ে যায়।
বস্তুত আট আনার লোহার চেয়ারে বসে কি করে যে ভালোক সেজে ফুটবল খেলা দেখা চলে তা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না। এ কি ক্রিকেট খেলা, যে পাঁচ ওভার ঠুকঠাক করবার পর খুঁচ করে একটা গ্লান্স হবে, না, সা করে একটা ড্রাইভ হবে। এর প্রতিটি মুহূর্ত উদ্বেগে উত্তেজনায় ঠাসা, বল এখন বিপক্ষের গোলের কাছে, পলক না পড়তেই আবার নিজের নিজের হৃৎপিণ্ডের দুয়ারে। সাধ্য কি তুমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে পার। এই, সেন্টার কর, ওকে পাশ দে, ঐখানে থ, মা—এমনি বহু নির্দেশ-উপদেশ দিতে হবে তোমাকে। শুধু তাই? কখনো কখনো শাসন-তিরস্কারও করতে হবে বৈ কি। খেলতে পারিস না তো নেমেছিস কেন, ল্যাকপ্যাক করছিস যে মাল খেয়ে নেমেছিস নাকি, বুক দিয়ে পড় গোলের কাছে, পা দুখানা যায় তো সোনা দিয়ে মিউজিয়মে বাঁধিয়ে রাখব। তারপর কেউ যদি গোল মিস করে, তখন আবার উল্লম্ফন : বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা মাঠ থেকে, গিন্নির আঁচল ধরে থাক গে। আর যদি রেফারি একটা অমনোমত রায় দেয় অমনি আবার উচ্চঘাষ : মারে, মারে শালাকে, থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দাও। এ সব মহৎ উত্তেজনা গ্যালারি ছাড়া আর কোথায় হওয়া সম্ভব? উঠে দাঁড়াতে না পারলে উল্লাস উল্লোল হওয়া যায় কি করে? তাই গ্যালারিতেই আমাদের কায়েমী আসন ছিল, মাঝ-মাঠে সেন্টারের কাছাকাছি, পাঁচ কি ছয় ধাপ উপরে। প্রায়ই আমরা এক সঙ্গে যেতাম কল্লোল-আপিস থেকে—দীনেশদা, সোমনাথ, গোরা, নৃপেন, প্রেমেন, সুধীন আর আমি কোনো কোন দিন আত ঘোষ সঙ্গে জুটত। আরো কিছু পরে অবোধ সান্যাল। অবিশ্যি যে সব দিন এগারোটা-বারোটায় এসে লাইন ধরতে হত সে সব দিন মাঠের বাইরে আগে থেকে সবাই একত্র হওয়া যেত না, কিন্তু মাঠে একবার ঢুকতে পেরেছ কি নিশ্চিন্ত আছ তোমার নির্ধারিত জায়গা আছে। নজরুল আরো পরে ঢেকে খেলার মাঠে এবং তখনো সে বেশ সন্ত্রান্ত ও খ্যাতিচিহ্নিত। তাই সে জনগণের গ্যালারিতে না এসে বসেছে গিয়ে আট আনার চেয়ারে, কিন্তু তার উল্লাস-উড্ডীন রঙিন উত্তরীয়টি ঠিক আছে। অবিশ্যি চাদর গায়ে দিয়ে খেলার মাঠে আসতে হলে অমনি উচ্চতর পদেই আসা উচিত। আমাদের তো জামা ফদা-ফাই আর জুতো চিচিংফাঁক। বৃষ্টি নেই এক বিন্দু, অথচ তিন ঘণ্টা ধস্তাধস্তি করে মাঠে ঢুকে দেখি এক হাঁটু কাদা। ব্যাপার কি? শুনলাম জনগণের মাথার ঘাম পায়ে পড়ে-পড়ে ভূমিতল কাদা হয়ে গেছে। সঙ্গে না আছে ছাতা না বা ওয়াটারপ্রুফ-শুধু এক চশমা সামলাতেই প্রাণান্ত। কনুয়ের ঠেলায় কত লোকের চশমা যে নাসিকাচ্যুত হয়েছে তার ইতি-অন্ত নেই। আর চক্ষুলজ্জাহীন চশমাই যদি চলে যায় তবে আর রইল কি? কখনো-কখনো ভূমিপৃষ্ঠ থেকে পাদস্পর্শ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, জলে ভাসা জানি, এ দেখছি সূলে ভাসা। নগ্ন। পদের খেলা দেখতে রিক্ত হাতে শূন্য মাথায় কখনো ব নগ্ন পদেই মাঠে ঢুকেছি।
শুধু গোকুলকেই দেখিনি মাঠে, তার কারণ কল্লোলের দ্বিতীয় বছরেই ভার অমুখ করে আর সে-অসুখ আর তার সারে না। কিন্তু যতদুর মনে পড়ে শৈলজা একদিন গিয়েছিল আর চুপি-চুপি জিগগেস করেছিল, গোঠ পাল কোন জন? আরো পরে, বুদ্ধদেব বসুকে একদিন নিয়ে গিয়েছিলাম, সে বলেছিল, কনার আবার কাকে বলে? শুনেছি ওরা আর দ্বিতীয় দিন মাঠে যায়নি।
তবু তো এখন কিউ হয়েছে, আগে-আগে ঘোড়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে ঢুকতে হয়েছে, মাঝদিকে তার কাছ থেকে বেশি দরে টিকিট কিনে। আগে-আগে গ্যালারির বাইরে কাটা-তারের বন্ধন ছিল না, বাইরের কত লোককে যে কত জনে টেনে তুলেছে ভিতর থেকে তার লেখাজোখা নেই। যাকে টেনে তুলছে সে যে সব সময়ে পরিচিত বা আত্মীয়বস্তু তার কোনো মানে নেই, দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাও বলা যায় না, তবু নিঃস্বার্থভাবে পরোপকার করা—এই একটা নিষ্কাম আনন্দ ছিল। এখন কাঁটাতালের বড় কড়াকড়ি, এখন কিউর লাইন এসে দাঁড়ায় হল-য়্যাণ্ড-য়্যাণ্ডাসন পর্যন্ত, খেলা দেখায় আর সেই পৌরুষ কই।
নরক গুলজার করে খেলা দেখতাম সবাই। উল্লাসজ্ঞাপনের যত রকম রীতিপদ্ধতি আছে সব মেনে চলতাম। এমন কি পাশের লোকের হাত থেকে কেড়ে ছাতা ওড়ানো পর্যন্ত। বৃষ্টি বদি নামত তো চেঁচিয়ে উঠতাম সবার সঙ্গে : ছাতা বন্ধ, ছাতা বন্ধ। যাড সোজা বেখে ভিজতাম। শেষকালে যখন চশমার কাচ মুছবার জন্যে আর কোনো কাপড় থাকত না তখনই বাধ্য হয়ে কারু ছাতার আশ্রয়ে বসে পড়তে হত। খেলা যদি দেখতে চাও তো বসে থাকে। ভিড়ে বেরাল হয়ে। মনে আছে এমনি এক বর্ষার মাঠে হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে এক ছাতার তলায় গুড়ি মেরে বসেছিলাম সারাক্ষণ। বৃষ্টির জলের চেয়ে পার্শ্ববর্তী ছাতার জলই যে বেশি বিরক্তিকর মর্মে মর্মে বুঝেছিলাম সেদিন।