সেসব দিনে খেলার মাঠে ঢোকার লাঞ্ছনার কথা ছেড়ে দিই, খেলা মাঠে ঢুকে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে যে অবিচার অনুষ্ঠিত হতে দেখে দেশের লোক, তাতে রক্ত ও বাক্য দুইই তপ্ত হয়ে উঠেছে ইংরেজের বিরুদ্ধে। আর এই তপ্ত বাক্য আর রক্তই ঘরে-বাইরে স্বাধীন হবার সংকল্পে ধার জুগিয়েছে। সেসব দিনের রেফারিগিরি করা ইংরেজের একচেটে ছিল, আর সেই একচোখো রেফারি পদে-পদে মোহনবাগানকে বিড়ম্বিত করেছে। অবধারিত গোল দেবে মোহনবাগান, হুইসল দিয়েছে অফসাইড বলে। ফাউল করলে ক্যালকাটা, ফাউল দিলে না, যদি বা দিলে, দিলে মোহনবাগানের বিপক্ষে। কিছুতেই মোহনবাগানকে দাবানো যাচ্ছে না, বিনামেঘে বজ্রপাতের মত বলা-কওয়া-নেই দিয়ে বসল। পেনাল্টি। একেকটা জোচ্ছরি এমন দুকান-কাটা ছিল যে সাহেবদের কানও লাল না হয়ে থাকতে পারত না। একবার এমনি ক্যালকাটা। সঙ্গে খেলায় মোহনবাগানের বিরুদ্ধে রেফারি হঠাৎ পেনাল্টি দিয়ে বসল। যেটা খুবই অসাধারণ, ব্যাক থেকে কলভিন না বেনেট এল শট করতে। শট করে সে-বল সে গোলের দিকে না পাঠিয়ে কয়েক মাইল দূর দিয়ে পাঠিয়ে দিলে। সেটা রেফারির গালে প্রায় চড় মারার মত-দিবালোকের মত এমন নিলজ্জ ছিল সেই পেনাল্টি। খেলোয়াড়ের পক্ষে রেফারিকে মারা অত্যন্ত গর্হিত কর্ম সন্দেহ নেই, কিন্তু তিক্তবিরক্ত হয়ে সেদিন যে ভ্যালহৌসির মাঠে বলাই চাটুজ্জে ক্লেটন সাহেবকে মেরেছিল সেটা অবিস্মরণীয় ইতিহাস হয়ে থাকবে।
শুধু রেফারি কেন, সমস্ত শাসকবংশই মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রী ছিল। নইলে ১৩০৩ সালে মোহনবাগানকে ক্যালকাটার বিরুদ্ধে শি-ফাইন্যালে খেলানো হত না। সেদিন রাত থেকে ভুবনপ্লাবন বা, সারা দিনে এক বিন্দু বিরাম নেই। মাঠে এক হাঁটু জল, কোথাও বা এক কোমর, হেলো না থাকলে সে-মাঠে অনায়াসে ওয়াটার-পোলদা খেলা চলে। ফুটবল বর্ষাকালের খেলা সন্দেহ নেই, কিন্তু বর্ষারও একটা সীমা আছে সভ্য আছে। মোহনবাগান তখন দুর্ধর্ষ দল, ফরোয়াডে শরৎ সিজি, কুমার আর রবি গাঙ্গুলি—তিন তিনটে অভ্রান্ত বুলেট-আর ব্যাকে সেই দুর্ভেদ্য চীনের দেয়ালগোষ্ঠ পাল। ক্যালকাটা ভাল করেই জানে শুকনো মাঠে এই দুর্বারণ মোহনবাগানকে কিছুতেই শায়েস্তা করা যাবে না। সুতরাং বানভাসা মাঠে একবার তাকে নামাতে পারলেই সে কোনঠাসা হয়ে যাবে! শেষদিকে বৃষ্টি বন্ধ করানো গেলেও খেলা কিছুতেই বন্ধ করানো গেল না। ক্যালকাটা কতৃপক্ষের সে অসঙ্গত অনতা পরোক্ষে দেশের মেরুদণ্ডকেই আরো বেশি উদ্ধত করে তুললে। যে করে হোক পরাভূত করতে হবে এই দম্ভদৃপ্তকে। যে সহজ প্রতি যোগিতার ক্ষেত্রে এসেও ভুলতে পারে না সে উপবিতন, সে একতন্ত্রী।
আর, মোহনবাগানকেও বলিহরি। খেলছিস ফুটবল, ছুটতে গিয়ে যেখানে প্রতিপদে আছাড় খেতে হবে, পায়ে বুট পরে নিস না কেন? উপায় কি, বুট পরলে আর ছুট দিতে পারব না, ছেলেবেলা থেকে অভোস বে। দেশে-গাঁয়ে যখন বাতাবি নেবু পিটেছি তখন থেকে, সেই সুরুর থেকেই তো খালি-পা। জুতো কিনি তার সঙ্গতি কই? স্কুল-কলেজে যাবার জন্যে এক জোড়া জোটানোই কষ্টকর, তায় মাঠে-মাঠে লাফাবার জন্যে আরেক জোড়া? মোটে মা রাধেন না, তং আর। পান্তা। দেখ না এই খালি পায়েই কেমন পক্ষিরাজ ঘোড়া ছুটাই। কেমন দিগ্বিজয় করে আসি। ভেব না, তাক লাগিয়ে দেব পৃথিবীর। খালি পায়েই ঘায়েল করব বুটকে। উনিশশো এগারো সনে এই খালি পায়েই শিল্ড এনেছিলাম। এবার পারলাম না, কিন্তু, দেখো, আবার পারব। যে সব তোমরা।
যাব তো ঠিক, কিন্তু দুপুরের দিকে হঠাৎ কোথা থেকে এক টুকরো কালো মেঘ ভেসে এসেছে, অমনি নিমেষে সকলের মুখ কালো হয়ে গেল। হে মা কালীঘাটের কালী, হে মা কালীতলার কালী, তোমরা কে বেশি কালো জানি না, কিন্তু এ মেঘ তোমাদের গায়ে মেখে-মেখে মুছে দাও মা, তোমাদের কালো কেশে উড়িয়ে নিয়ে যাও কৈলাসে। কত তুকতাক, কত মানৎ, কত ইষ্টম, হাওয়া উঠুক, ধুলো উডুক, মেঘ লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক। সব সময় প্রার্থনা কি আর শোনে! মেঘের পরে মেঘ শুধু জমাটই হতে থাকে, ঘন নৈরাশ্যের পর ঘনতর মনস্তাপ। সে যে কী দুঃসময় তা কে বা বোঝে, কাকে বা বোঝাই! ঘাড় গলা উঁচু করে শুধু আকাশের দিকে তাকানো আর মেঘের অবয়ব আর চরিত্র নিয়ে গবেষণা। পশ্চিমের মেঘ যে অমোঘ হয় এই মন্তুদ সত্য চার আনার সবুজ গ্যালারিতে বসেই প্রথম উপলব্ধি করেছি। ফটিকজল পাখি আছে শুনেছি, এখন দেখলাম ফটিকয়োদ পাখি। যারা জ্বল চায় না রোদ চায়, মেঘের বদলে মরুলীর জন্যে হা হা করে। হেনে বৃষ্টি আসবার ছড়া আছে, মেঘ-মাণমন্ত্রের প্রথম ছড়া সৃষ্টি হয় এই মোহনবাগানের মাঠে!
ওরে মেঘ দূরে
যা শিগগির উড়ে।
নেবুর পাতা করমচা
রকে বসে গরম চা!
তবু, পাহাড় সরে তো মেঘ সরে না। ব্যঙ্গের ভঙ্গিমায় নেমে আসে বাস্তব বৃষ্টি। মনে হয় না ঘনকৃষ্ণ কেশ আকুলিত করে কেউ কোনো নীপবনে ধারাস্নান করছে। বরং মনে হচ্ছে দেশের মাথার উপর ঝরে পড়ছে দোর্দণ্ড অভিশাপ। আর যেমনি জল ঝরল অমনি মোহনবাগানের জৌলুস গেল ধুয়ে। আশ্চর্য, তখন তাতে না রইল আর বাগান, না বা রইল মোহ। তখন তার নাম গোয়াবাগান বা বাদুড়বাগান রাখলেও কোন ক্ষতি নেই।
তবু কালে-ভদ্রে এমন একেকটা বোমহর্ষক খেলা সে জিতে ফেলে যে তার উপর আবার মায়া পড়ে, মন বসে। বারেবারে প্রতিজ্ঞা করে মাঠ থেকে বেরিয়েছি ও-হতচ্ছাড়ার খেলা আর দেখব না, আবার বারেবারেই প্রতিজ্ঞা-ভক্ত হয়েছে। তাই তেরোশো তিরিশের হারের পরও যে আবার মাঠে যাব—কল্লোলের দল নিয়ে—তা আর বিচিত্র কি। ওরা খেলে না জিতুক, আমরা অন্তত চেঁচিয়ে জিতব। জিত আমাদের হবেই, হয় খেলায় নয় এই একত্বমেলায়।