আমার মনে হয় আনন্দ আমার কাছে আনন্দ আর দুঃখ দুঃখ, শুধু এই জন্যেই যে, আনন্দ জীবনের সার্থকতার প্রমাণ আর দুঃখ মৃত্যুর
কুটি। কথাটা একটু হেঁয়ালি ঠেকছে। আর যখন দেখা যায় আনন্দ জীবনের মূলচ্ছেদেও মাঝে মাঝে পাওয়া যায় তখন আরো হেঁয়ালি দাঁড়ায় বটে কথাটা। তবু আমার মনে হয় কথাটা সত্যি।
আর এ ছাড়াও, অর্থাৎ এ যদি সত্যি না হয়, তবু আনন্দ ছাড়া জীবনের পথের পাতা আর আমাদের কেউ নেই। যারা কর্তব্য-কর্তব্য বা বিবেক-বিবেক বলে চেঁচিরে মরে তারা আমার মনে হয় একেবারে অন্ধ, না হয় একেবারে পাগল। কি কর্তব্য আর বিবেক কি বলে এটা যদি ঠিক করতেই পারা যাবে তাহলে আর এত গোল কেন? জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তো বিবেক তৈরি হয়েছে আর কর্তব্য-অকর্তব্য প্রাণ পেয়েছে।
এই যে পাণ্ডাটি আমাদের, এ মাঝে-মাঝে ভুল করে, কিন্তু নাচার হয়ে আমাদের তাকেই সঙ্গে নিতে হবে পথ দেখাতে।
এমনিতর অনেক কথা ভাবি কিন্তু কিছু ঠিক করতে পারি না। ছেলেবেলা একটা সহজ idealism ছিল, ভালো মন্দ বেশ সুস্পষ্টভাবে মনে বিভক্ত হয়ে থাকত। মনে হত পথটা জানি চলাটাই শক্তএখন দেখছি চলার চেয়ে পথটা জানা কম কথা নয়।
এই ধর জীবনের একটা programme দিই। বিদ্যা জ্ঞান স্বাস্থ্য শক্তি সৌন্দর্য শিল্পসাধনা গেল প্রথম। দ্বিতীয় ভালবাসা পাবার। ধর পেলুম কি পেলুম না। তারপর আরো সাধনা পরিপূর্ণতার জন্যে। পরের উপকার, বিশ্বমানবের জন্যে দরদ, পৃথিবীজোড়া দুঃখ দারিদ্র্য হাহাকারের প্রতিকার চেষ্টায় যথাসাধ্য নিজেকে লাগান। তৃতীয় সারা জীবন ধরেই ভূমার জন্য তপস্যা, সারাজীবন ধরে দুঃখকে অবহেলা করবার ব্যর্থতাকে তুচ্ছ করবার মৃত্যুকে উপহাস করবার শক্তি অর্জন।
বেশ! মন্দ কি। কিন্তু যত সহজ দেখাচ্ছে ব্যাপারটা, আসলে মোটই এমনি সহজে মীমাংসা হয় না। কি যে ভূমা আর কি যে পরিপূর্ণত, কি যে মানুষের উপকার আর কি যে শিল্প আর জ্ঞান তা কি মীমাংসা হল?…
না। মাথা গুলিয়ে যায়। আসল কথা হচ্ছে এই যে, আফ্রিকার সব চেয়ে আদিম অসভ্য Bushman-এর একটা বিংশ শতাব্দীর সম্পূর্ণ এয়োপ্লেন পেলে যে অবস্থা হয় আমাদের এই জীবনটা নিয়ে হয়েছে তাই। আমরা জানি না এটা কি এবং কেন? এর কোথায় কি তা তো জানিই না, এর সার্থকতা ও উদ্দেশ্য কি তাও জানি না। হয়ত আমাদের আনাড়ি নাড়াচাড়ায় কোন একটা কল নড়ে-চড়ে পাখাটা একবার ঘুরে উঠছে, আমরা ভাবছি হাওয়া খাওয়াই এর উদ্দেশ্য, কি হয়ত পাখা লেগে কারুর গা হাত-পা কেটে যাচ্ছে তখন ভাবছি এটা একটা উৎপীড়ন।
উপমাটা ঠিক হল না। কারণ অবস্থা ওর চেয়ে খারাপ এবং আফ্রিকার Bushmat-এর কাছে একটা এয়োপ্লেন যত জটিল ও অর্থহীন, অদ্ভুত জীবনটা আমাদের কাছে তার চেয়ে ঢের বেশি। মানুষ কত কোটি বছর পৃথিবীতে এসেছে এ নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের তর্ক আজও শেষ হয়নি, সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি, কিন্তু জীবনের অর্থ যে আজও পাওয়া যায়নি এ নিয়ে মতভেদ নেই বোধ হয়।
কবিত্ব করা যায় বটে এই বলে যে বোঝা যায়না বলেই জীবন অপরূপ মধুর সুন্দর, কিন্তু ভাই, মন হা হা করে। কি করি এই দুর্বোধ অনধিগম্য জীবন নিয়ে? যতদিন না মৃত্যু-শীতল হাত থেকে আপনি খসে পড়বে ততদিন এমনি করে ছুটোছুটি করে মরব আর কেঁদে কাটাব?
তা ছাড়া শুধু সুখ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবার উপায়ও যদি থাকত। তাও ত নেই। আমি হয়ত কুৎসিত আর একজন চিররুগ্ন, আর একজন নির্বোধ, আর একজন অন্ধ বা পঙ্গু, আর একজন দীন ভিখারীর মেয়ে। বলছ আনন্দ না পাও আনন্দের সাধনা কর, কেমন? কিন্তু জন্মান্ধের দেখতে পাবার সাধনা খন্ধের নৃত্যসাধনা করা বোকামি নয় কি? স্কুল জগতে যেমন দেখছি মনের জগতেও অমনি নেই কে বলতে পারে? বোবা হয়ে গানের সাধনা তপস্যা করতে বল কি? জীবনের কোন গানের সাধনায় আমি যোবা তাত জানি না। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ি যদি হয় ত আমার গায়েই লাগবে।
কি হবে এত সব জিজ্ঞাসায় জর্জরিত হয়ে, সক্রেটিসীয় দার্শনিকের মত মৃত্যুরূপী পরিপূর্ণতার প্রতীক্ষা করে? তার চেয়ে চলল, মাঠে চলল, মোহনবাগানের খেলা দেখে আসি।
মোহনবাগান। আজকাল আর যেন তেমন করে বাজে না বুকের মধ্যে। সেই ইস্ট ইয়র্কস নেই, ব্ল্যাক-ওয়াচ ডারহামস এইচ-এল-আই ডি-সি-এল-আই নেই, সেই মোহনবাগানও নেই। আজকালকার মোহনবাগান যেন মোহন সিরিজের উপন্যাসের মতই বাসি।
কিন্তু সেসব দিনের মোহনবাগান মৃত দেশের পক্ষে সঞ্জীবনী ছিল। বলা বাহুল্য হবে না, রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন ছিল বন্দেমাতরম তেমনি খেলার ক্ষেত্রে মোহনবাগান। পলাশীর মাঠে যে কলঙ্কঅর্জন হয়েছিল তার স্থান হবে এই খেলার মাঠে। আসলে, মোহনবাগান একটা ক্লাব নয়, দল নয়, সে সমগ্র দেশ—পরাভূত, পদানত দেশ, সেই দেশের সে উদ্ধত বিজয়-নিশান।
এ কথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না যে মোহনবাগানের খেলার মাঠেই বাঙলা দেশের জাতীয়তাবোধ পরিপুষ্ট হয়েছিল। যে ইংরেজবিদ্বেষ মনে-মনে ধূমায়িত ছিল মোহনবাগান তাতে বাতাস দিয়ে বিশুদ্ধ আগুনের সুস্পষ্টতা এনে দিয়েছে। অত্যাচারিতের যে অসহায়তা থেকে টেররিজম জন্ম নেয় হয়তো তার প্রথম অঙ্কুর মাথা তুলেছি এই খেলার মাঠে। তখনো খেলার মাঠে সাম্প্রদায়িকতা ঢোকেনি, মোহনবাগান তখন হিন্দু-মুসলমানের সমান মোহনবাগান—তার মধ্যে নেবুবাগান কলাবাগান ছিল না। সেদিন যে ক্যালকাটা মাঠের সবুজ গ্যালারি পুড়েছিল তাতে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, একজন এনেছিল পেল, আরেকজন এনেছিল দিয়াশলাই। সওয়ার পুলিশের উজ্জ্বল ঘোড়ার খুলে একসঙ্গে জখম হয়েছিলে দুজনে।