আর নৃপেনের গলায় রবীন্দ্রনাথের প্রতিধ্বনি :
মৃত্যু তোর হোক দূরে নিশীথে নির্জনে,
হোক সেই পথে যেথা সমুদ্রের তরঙ্গগর্জনে,
গৃহহীন পথিকেরি
নৃত্যচ্ছন্দে নিত্যকাল বাজিতেছে ভেরী
অজানা অরণ্যে যেথা উঠিতেছে উদাসমর্মর
বিদেশের বিবাগী নির্ঝর
বিদায় গানের তালে হাসিয়া বাজায় করতালি,
যেথায় অপরিচিত নক্ষত্রের আরতির থালি
চলিয়াছে অনন্তের মন্দিরসন্ধানে,
পিছু ফিরে চাহিবার কিছু যেথা নাই কোনোখানে।
দুয়ার রহিবে খোলা, ধরিত্রীর সমুদ্রপর্বত
কেহ ডাকিবে না কাছে, সকলেই দেখাইবে পথ।
শিয়রে নিশীথরাত্রি বহিবে নির্বাক,
মৃত্যু সে যে পথিকেরে ডাক।।
পথিকেরা সেই ডাক যেন তখন একটু বেশি-বেশি শুনছিল। পথিকদের তার জন্যে খুব দোষ দেয়া যায় না। তাদের পকেট গড়ের মাঠ, ভবিষ্যৎ অনির্ণেয়। অভিভাবক প্রতিকুল, সমালোচক যমদূতের প্রতিমূর্তি। ঘরেবাইরে সমান খড়গহস্ততা। এক ভরসাস্থল প্রণয়িনী, তা তিনিও পলায়নপর, বামলোচন। আর তাঁর যারা অভিভাবক তারা আকাট গুণ্ডামার্কা। এই অসম্ভব পরিস্থিতিতে কেউ যদি মরণকে শ্যামসমান বলে, মিথ্যে বলে না।
১০. প্রেমেনের দুটো চিঠি
জিজ্ঞাসা ও নৈরাশ্য, সংগ্রাম ও অপূর্ণতা এই দুই যতির মধ্যে দুলছে তখন কল্লোলের ছন্দ। সে সময়কার প্রেমেনের দুটো চিঠি—প্রথমটা এই–
অচিন, আমি অধঃপাতে চলেছি। তাও যদি ভালো ভাবে যেতে পারতুম! জীবন নিয়ে কি করতে চাই ভালো করে বুঝি না, যা বুঝি তাও করতে পারি না। মাঝে-মাঝে ভাবি, বোঝবার দরকার কিছু আছে কি? এই যে দার্শনিক কবি মানবহিতৈষী মহাপুরুষেরা মাথা ঘামিয়ে মরছেন এ ঘর্ম বোধ হয় একেবারেই নিরর্থক। জীবনটাকে যে বেঁকিয়ে দুমড়ে বিকৃত করে ছেড়ে গেল, আর যে প্রাণপণ শক্তিতে জীবনকে কবিতা করার চেষ্টা করলে, দুজনেই বাজে কাজে হয়রান হল সমানই। তুমি বলবে আনন্দ আর দুঃখ—আমি বলি, তার চেয়ে ছেড়ে দাও, যার আদি বুঝি না অন্ত বুঝি না, ছেড়ে দাও তাকে নিজের খেয়ালে। হাসি পেলে হাস, আর যেদিন শ্রাবণের আকাশ অন্ধকারে আর্দ্র হয়ে উঠবে সেদিন জেনে ও মেনো কাদতে পাওয়াটাই পরম সৌভাগ্য। কোন দিন যদি খুশী হয়, নিজের সমস্ত সত্যকে মিথ্যার খোলসে ঢেকে নিজের সঙ্গে খুব বড় একটা পরিহাস কোরো, কোন ক্ষতি হবে না।
আমরা ছোট মানুষ, কুয়োর ব্যাঙ, কিছু জানি না, তাই ভাবি আমরা মস্ত একটা কিছু। নিজেদের জগতে চলাফেরা করি, ছোষ্ট্র চেতনার আলোকে নিজের ঘরে নিজের সত্তার প্রকাণ্ড ছায়াটা দেখি আর মনে মনে বড়-বড় খেলা করি। কিন্তু ভাই আজ যদি এই পৃথিবীর গায়ের চুলকানির কীটের মত এই সমস্ত মানুষ জাতটার সবাই মিলে পণ করে উচ্ছন্নে যাই, এই বিপুল নিখিলে এই বিরাট আকাশে কোনখানে এতটুকু কান্না জাগবে না, উল্কাপাত হবে না, অগ্নি বৃষ্টি হবে না, প্রলয় হবে না, বিরাট নিখিলে একটি চোখের পালক খসবে না।
তবে যদি মানুষকে একটা কথা শেখাতে চাও, আমি তোমার মতেযদি এই নির্বোধ মানুষ জাতটাকে শেখাও শুধু স্ফূর্তির, নিছক স্ফুর্তির উপাসনা—এই দেবতা-ঠাকুরকে দূর করে দিয়ে, ঝেটিয়ে ফেলে সব সমাজশাসন সব নীতির অনুশাসন—শুধু জীবনটাকে আনন্দের সাবথানায় অপব্যয় করতে—তবে রাজী আমি।
কিন্তু আনন্দ, সত্যকারের আনন্দ পেতে হলে চাই আবার সেই বন্ধন, চাই আবার সেই সমাজশাসন, যদিও উদারতর; চাই সত্যের ভিৎ, যদিও দৃঢ়তর-চাই সচেতন সৃষ্টি প্রতিভা, চাই বিভিন্ন জীবনপ্রেরণার এমন সংযম ও সংযোগ যা সঙ্গীত।
সুতরাং এতক্ষণ সব বাজে বকেছি-বাজে বকব বলেই বাজে বকেছি। কারণ চিঠি লেখার চরম উদ্দেশ্য জীবনের নির্মম বাস্তবতাকে। কিছুক্ষণের জন্যে অপদস্থ করে হাস্যাস্পদ করা।
আজ এখানে বেজায় বাদল, কাল থেকেই শুরু হয়েছে। শাল মুড়ি দিয়ে এলোমেলো বিছানায় বসে চিঠি লিখছি। এখন রাত সাড়ে সাতটা হবে। খুব সম্ভব তুই এখন গল্প লিখছিস-লিখছিস হয়ত বিরহী নায়ক তার প্রিয়ার ঘরের প্রদীপের আলোকে নিজের ব্যর্থ কামনার মৃত্যু দেখছে। হয়ত কোন ব্যথিত প্রণয়ী তোর হৃদয়ের কান্নার উৎসে জন্ম নিয়ে আজ চলল মানুষের আনন্দলোকের অবিনাশী মহাসভায়—যেখানে কালিদাসের যক্ষ আজো বিলাপ কয়ছে, যেখানে পৃথিবীর সমস্ত মানবষ্টর সৃষ্টি অমর হয়ে আছে।
একদিন নাকি পৃথিবীতে কান্না থাকবে না, কদবার কিছু থাকবে না। সেদিনকার হতভাগ্য মানুষেরা হয়ত শখ করে তোদের সভায় কাঁদতে আসবে আর আশীর্বাদ করবে এই তোদের, যারা তাদের ক্রন্দনহীন জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিবি।
দ্বিতীয় চিঠি।
বড় দুঃখ আমার এই যে কোন কাজই ভাল করে করতে পারলুম না। জীবনের মানেও বুঝতে পারি না। জানি শক্তিসংগ্রহে সুখ, পূর্ণ উপভোগ সুখ। কিন্তু সুখ আর কল্যাণ কোথায় এক হচ্ছে বুঝতে পারি না।
জীবনটা যখন চলা তখন একটা দিকে ত চলা দরকার, চার দিকে সমানভাবে দৌড়াদৌড়ি করলে কোন লাভ হবে না নিশ্চয়ই। সেই পথের লক্ষ্যটা একমাত্র আনন্দ ছাড়া আর কি করা যেতে পারে ভেবে পাচ্ছি না।…
আনন্দ কল্যাণের সঙ্গে না মিশলেই যায় সব ভেঙে। অনেক ধনী হয়ে অনেক টাকা বাজে অপব্যয় করার আনন্দ আছে, খুব ব্যভিচারী লম্পট হওয়াতেও আনন্দ আছে, সর্বত্যাগী বৈরাগী তপন্থী সন্ন্যাসী হওয়াতে আনন্দ আছে, কিন্তু কল্যাণের সঙ্গে আনন্দ মেশে না, তাই গোল। এগিয়েও ভুল করতে পারি, পেছিয়েও। পাল্লা সমান রেখে কেমন করে চলা যায় তাও ত ভেবে পাই না।