বহু তর্ক ও আস্ফালন, বহু প্রতিজ্ঞা ও ভবিষ্যচিত্বন হয়েছে সেই ফেভরিট কেবিনে। কল্লোল সম্পূর্ণ হত না যদি না সেদিন ফেভরিট কেবিন থাকত।
এক-একদিন শুকনো চায়ে মন মানত না। ধোঁয়া ও গন্ধ-ওড়ানো তপ্ত-পক্ক মাংসের জন্যে লালসা হত। তখন দেলখোস কেবিনের জেল্লাজমক খুব, নাতিদূরে ইণ্ডোৰ্মার পরিচ্ছন্ন নতুনত্ব। কিন্তু খুব বিরল দিনে খুব সাহস করে সে-সব জায়গায় ঢুকলেও সামান্য চপ-কাটলেটের বেশি জায়গা দিতে পকেট কিছুতেই রাজি হত না। পেট ও পকেটের এই অসামঞ্জস্যের জন্যে ললাটকে দায়ী করেই শান্ত হতাম। কিন্তু সাময়িক শান্তি অর্থ চিরকালের জন্যে ক্ষান্ত হওয়া নয়। অন্তত নৃপেন জানত না ক্ষান্ত হতে। তার একমুখো মন ঠিক একটা না-একটা ব্যবস্থা করে উঠতই।
একদিন হয়তো বললে, চল কিছু খাওয়া যাক পেট ভরে। বাঙালি পাড়ায় নয়, চীনে পাড়ায়।
উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। পয়সা?
পয়সা যে নেই তুই ও জানিস আমিও জানি। ও প্রশ্ন করে লাভ নেই।
তবে?
চল, বেরিয়ে পড়া যাক একসঙ্গে। বেগ-বরো-অর-ষ্টিল, একটা হিল্লে নিশ্চয়ই কোথাও হবে। আশা করি চেয়ে-চিন্তে ধারধুর করেই জুটে যাবে। শেষেরটার দরকার হবে না।
দুজনে হাঁটতে সুরু করলাম, প্রায় বেলতলা থেকে নিমতলা, সাহাপুর থেকে কাশীপুর। প্রথম প্রথম নৃপেন মোল আনা চেনা বাড়িতে ঢুকতে লাগল, শেষকালে দু-আনা এক-অন। চেনায়ও পেছপা হল না। মুখচেনা নামচেনা কিছুতেই তার উচ্চম-ভঙ্গ নেই। আমাকে রাস্তায় দাড় করিয়ে রেখে একেকটা বাড়িতে গিয়ে ঢোকে আর বেরিয়ে আসে শূন্য মুখে, বলে, কিছুই হল না, কিংবা বাড়ি নেই কেউ, কিংবা ছোট একটি অভিশপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে দুচরণ মেঘদূত আওড়ায়। এমনিতে স্থির হয়ে বসে থাকতে যা হত হাঁটার দরুন খিদেটা বহুগুণ চনচনে হয়ে উঠল। যত তীব্র তোমার ক্ষুধা তত দূর তোমার যাত্রা। সুতরাং থামলে চলবে না, না থামাটাই তো তোমার খিদে-পাওয়ার সত্যিকার সাক্ষ্য। কিন্তু রাত সাড়ে আটটা বাজে, ডিনার টাইম প্রায় উত্তীর্ণ হয়ে গেল, আর মায়া বাড়িয়ে লাভ কি, এবার ভাল ছেলের মত বাড়ি ফিরে যৎ প্রাপ্তং তৎ ভক্ষিতং করি গে। হাত ধরে বাধা দিলাম নৃপেনকে, বললাম, এ পর্যন্ত ঠিক কত পেয়েছিস বল সত্যি করে?
হাতের মুঠ খুলে অম্লান মুখে নৃপেন বললে, মাইরি বলছি, মাত্র দুটাকা।
দু টাকা! দুটাকায় প্রকাণ্ড খ্যাঁট হবে। ঈষদূন খাওয়া যাবে আকণ্ঠ। তবে এখনো চীন দেশে না গিয়ে শ্যামরাজ্যে আছি কেন?
হতাশমুখে নৃপেন বললে, এ দুটাকায় কিছুই হবে না, এ দুটাকা আমার কালকের বাজার-খরচ।
এই আমাদের রোমাণ্টিক নৃপেন, একদিকে বিদ্রোহী, অন্যদিকে ভাবানুরাগী। ভাগ্যের রসিকতায় নিজেও ভাগ্যের প্রতি পরিহাসপ্রবণ। বস্তুত কল্লোল যুগে এ দুটোই প্রধান সুর ছিল, এক, প্রবল বিরুদ্ধবাদ; দুই, বিহ্বল ভাববিলাস। একদিকে অনিয়মাধীন উদ্দামতা, অন্যদিকে সর্বব্যাপী নিরর্থকতার কাব্য। একদিকে সংগ্রামের মহিমা, অন্যদিকে ব্যর্থতার মাধুরী। আদর্শবাদী যুবক প্রতিকূল জীবনের প্রতিঘাতে নিবারিত হচ্ছে-এই যন্ত্রণাটা সেই যুগের যন্ত্রণা। শুধু বন্ধ দরজায় মাথা খুড়ছে, কোথাও আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে না, কিংবা যে জায়গায় পাচ্ছে তা তার আত্মার আনুপাতিক নয়—এই অসন্তোষে এই অপূর্ণতায় সে। ছিন্নভিন্ন। বাইরে যেখানে বা বাধা নেই সেখানে বাধা তার মনে, তার স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের অবনিবনায়। তাই একদিকে যেমন তার বিপ্লবের অস্থিরতা, অন্যদিকে তেমনি বিফলতার অবসাদ।
যাকে বলে ম্যালাডি অফ দি এজ বা যুগের যন্ত্রণা তা কল্লোলের মুখে স্পষ্টরেখায় উৎকীর্ণ। আগে এর প্রচ্ছদপটে দেখেছি একটি নিঃসম্বল ভাবুক যুবকের ছবি, সমুদ্র পাবে নিঃসঙ্গ ঔদাস্যে বসে আছেকেন-উত্তাল তরঙ্গশৃঙ্গট। তার থেকে তখনও অনেক দূরে। তেরোশ একত্রিশের আশ্বিনে সে-সমুদ্র একেবারে তীর গ্রাস করে এগিয়ে এসেছে, তরঙ্গতরল বিশাল উল্লাসে ভেঙে ফেলছে কোন পুরোনো না পোড়ো মন্দিরের বনিয়াদ। এই দুই ভাবের অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল কল্লোলে। কখনো উন্মত্ত, কখনো উন্মনা। কখনো সংগ্রাম, কখনো বা জীবনবিতৃষ্ণা। প্রায় টুর্গেনিভের চরিত্র। ভাবে শেলীয়ান, কর্মে হ্যামলেটিশ।
এ সময়টায় আমরা মৃত্যুর প্রেমে পড়েছিলাম। বিপ্লবীর জন্যে সে সময় মৃত্যুটা বড়ই রোমাণ্টিক ছিল—সে বিপ্লব রাজনীতিই হোক বা সাহিত্যনীতিই হোক। আর, সঙ্গ বা পরিপার্শ্ব অনুসারে রাজনীতি না হয়ে আমাদের ভাগে সাহিত্য। নইলে দুই ক্ষেত্রেই এক বিদ্রোহের আগুন, এক ধ্বংসের অনিবার্যতা। এক কথায়, একই যুগ-যন্ত্রণা। তাই সেদিন মৃত্যুকে যে প্রেয়সীর সুন্দর মুখের চেয়েও সুন্দর মনে হবে তাতে আর বিচিত্র কি।
সেই দিন তাই লিখেছিলাম
নয়নে কাজল দিয়া
উলু দিও সখি, তব সাথে নয়, মৃত্যুর সাথে বিয়া।
আর প্রেমেন লিখেছিল :
আজ আমি চলে যাই
চলে যাই তবে,
পৃথিবীর ভাই বোন মোর
গ্রহতারকার দেশে,
সাক্ষী মোর এই জীবনের
কেহ চেনা কেহ বা অচেনা।
তোমাদের কাছ হতে চলে যাই তবে।
যে কেহ আমার ভাই যে কেহ ভগিনী,
এই উমি-উদ্বেলিত সাগরের গ্রহে
অপরূপ প্রভাত-সন্ধ্যার গ্রহে এই
লহ শেষ শুভ ইচ্ছা মোর,
বিদায়পরশ, ভালোবাসা;
আর তুমি লও মোর প্রিয়া
অনন্তরহস্যময়ী,
চিরকৌতূহল-জ্বালা—
অসমাপ্ত চুম্বনখানিরে
তৃপ্তিহীন।…
যত দুঃখ সহিয়াছি
বহিয়াছি যত বোঝা, পেয়েছি আঘাত
কাটায়েছি স্নেহহীন দিন
হয়ত বা বৃথা,
আজ কোনো ক্ষোভ নাই তার তরে
কোনো অনুতাপ আজ রেখে নাহি যাই—