তারপর একদিন কল্লোল আফিসে এসে উপস্থিত হলাম। ১২ পটুয়াটোলা লেন। মির্জাপুর স্ট্রিট ধরে গিয়ে বাঁ-হাতি।
কল্লোল-আফিস!
চেহারা দেখে প্রথমে দমে গিয়েছিলাম কি সেদিন? ছোট্ট দোতলা বাড়ি—একতলায় রাস্তার দিকে ছোট্ট বৈঠকখানায় কল্লোল-আফিস! বায়ে বেঁকে দুটো সিড়ি ভেঙে উঠে হাত-দুই চওড়া ছোট একটু নোয়ক ডিঙিয়ে ঘর। ঘরের মধ্যে উত্তরের দেওয়াল ঘেঁসে নিচু একজনের শোয়র মত ছোট একফালি তক্তপোশ, শতরঞ্চির উপর চাদর দিয়ে ঢাকা। পশ্চিম দিকের দেওয়ালের আধখানা জুড়ে একটি আলমারি, বাকি আধখানায় আধা-সেক্রেটারিয়েট টেবিল। পিছন দিকে ভিতরে যাবার দরজা, পর্দা ঝুলছে কি ঝুলছে না, জানতে চাওয়া অনাবশ্যক। ফাঁকা জায়গাটুকুতে খান দুই চেয়ার, আর একটি ক্যানভাসের ডেক-চেয়ার। ঐ ভেক চেয়ারটিই সমস্ত কল্লোল-আফিসের অভিজাত্য। প্রধান বিলাসিতা।
সম্পাদকী টেবিলে গোকুল নাগ বসে আছে, আমাকে দেখে সস্মিত শুভাগমন জানালে। তক্তপোশের উপর একটি প্রিয়দর্শন যুবক, নাম ভূপতি চৌধুরী, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ে, বাড়ির ঠিকানা ৫৭ আমহার্স্ট স্ট্রিট। আরো একটি ভদ্রলোক বসে, ছিমছাম ফিটফাট চেহারা, একটু বা গম্ভীর ধরনের। খোঁজ নিয়ে জানলাম, সতীপ্রসাদ সেন, কল্লোলের গোরাবাবু। দেখতে প্রথমটা একটু গম্ভীর, কিন্তু অপেক্ষা করে, পাবে তার অন্তরের মধুরতার পরিচয়।
ভূপতির সঙ্গে একবাক্যেই ভাব হয়ে গেল। দেখতে দেখতে চলে এল নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়।
কিন্তু প্রথম দিন সব চেয়ে যা মন ভোলাল তা হচ্ছে ঠিক সাড়েচারটের সময় বাড়ির ভিতর হতে আসা প্লেট-ভরা এক গোছা রুটি আর বাটিতে করে তরকারি। আর মাথা-গুনতি চায়ের কাপ।
ভাবলাম, প্রেমেনকে বলতে হবে। প্রেমেন আমার স্কুলের সঙ্গী। ম্যাট্রিক পাশ করেছি এক বছর।
০২. একটিমাত্র ছাত্র–প্রেমেন্দ্র মিত্র
সাউথ সুবার্বন স্কুলে ফার্স্ট ক্লাশে উঠে প্রেমেনকে ধরি। সে-সব দিনে ষোলো বছর না পুরলে ম্যাট্রিক দেওয়া যেত না। প্রেমেনের এক বছর ঘাটতি পড়েছে। তার মানে ষোলো কলার এক কলা তখন বাকি।
ধরে ফেললাম। লক্ষ্য করলাম সমস্ত ক্লাশের মধ্যে সব চেয়ে উজ্জ্বল, সব চেয়ে সুন্দর, সব চেয়ে অসাধারণ ঐ একটিমাত্র ছাত্র–প্রেমেন্দ্র মিত্র। এক মাথা ঘন কোঁকড়ানো চুল, সামনের দিকটা একটু আঁচড়ে বাকিটা এক কথায় অগ্রাহ্য করে দেওয়া—সুগঠিত দাতে সুখস্পর্শ হাসি, আর চোখের দৃষ্টিতে দূরভেদী বুদ্ধির প্রখরতা। এক ঘর ছেলের মধ্যে ঠিক চোখে পড়ার মত। চোখের বাইরে একলা ঘরে হয়তো বা কোনোকোনো দিন মনে পড়ার মত।
এক সেকশনে পড়েছি বটে কিন্তু কোনো দিন এক বেঞ্চিতে বসিনি। যে কথা-বলার জন্যে বেঞ্চির উপর উঠে দাঁড়াতে হয়, তেমন কোনো দিন কথা হয়নি পাশাপাশি বসে। তবু দূর থেকেই পরস্পরকে আবিষ্কার করলাম।
কিংবা, আদত কথা বলতে গেলে, আমাদের আবিষ্কার করলেন আমাদের বাংলার পণ্ডিত মশাই—নাম রণেন্দ্র গুপ্ত। ইস্কুলের ছাত্রদের মুখ-চলতি নাম রণেন পণ্ডিত।
গায়ের চাদর ডান হাতের বগলের নিচে দিয়ে চালান করে বা কাঁধের উপর ফেলে পাইচারি করে-করে পড়াতেন পণ্ডিত মশাই। অদ্ভুত তার পড়াবার ধরন, আশ্চর্য তাঁর বলবার কায়দা। থমথমে ভারী গলার মিষ্টি আওয়াজ এখনো যেন শুনতে পাচ্ছি।
নিচের দিকে সংস্কৃত পড়াতেন। পড়াতেন ছড়া তৈরি করে। একটা আমার এখনো মনে আছে। ব্যাকরণের সুত্র শেখাবার জন্যে সে ছড়া, কিন্তু সাহিত্যের আসরে তার জায়গা পাওয়া উচিত।
ব্যধ-যজ, এদের য-কার গেল
তার বদলে ই,
ই-কার উ-কার দীর্ঘ হল
ঋকারান্ত রি।
শাস্-এর হল শিষ-দেওয়া রোগ
অস্-এর হল ভূ,
স্বপ-সাহেবের সুপ এসেছে
হেব সাহেবের হু।
বহরমপুরের বাদীরা সব
বদমায়েসি ছেড়ে
চন্দ্র পরান দয়াল হরি
সবাই হল উড়ে।।
একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। বাচ্যান্তর শেখাচ্ছেন পণ্ডিত মশাই কতৃবাচ্য থেকে কর্মবাচ্য। তখন সংস্কৃত ধাতুগুলো কে কি-রকম চেহারা নেবে তারই একটা সরস নির্ঘণ্ট। তার মানে ব্যধ আর যজ–ধাতু য-ফলা বর্জন করে হয়ে দাঁড়াবে বিধ্যতে আর ইজতে। কৃয়তে-মৃয়তে না হয়ে হবে কিয়তে-মিয়তে। তেমনি শিষ্যতে, ভূয়তে, সুপ্যতে, হয়তে। বহরমপুরের বাদীরাই সব চেয়ে মজার। তারা সংখ্যায় চারজন-বচ, বপ, বদ আর বহ। কর্মবাচ্যে গেলে আর বদমায়েসি থাকবে না, সবাই উড়ে হয়ে যাবে। তার মানে, বউ হয়ে যাবে। তার মানে উচ্যতে, উপতে, উদ্যতে, উতে। তেমনি ভাববাচ্যে উক্ত, উপ্ত, উদিত, উঢ়। ছিল বক হয়ে দাঁড়াল উচ্চিংড়ে।
বাংলার রচনা-ক্লাশে তিনি অনায়াসে চিহ্নিত করলেন আমাদের দুজনকে। যা লিখে আনি তাই তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন ও আবো লেখবার জন্যে প্রবল প্ররোচনা দেন। একদিন দুঃসাহসে ভর করে তার হাতে আমার কবিতার খাতা তুলে দিলাম। তখনকার দিনে মেয়েদের গান গাওয়া বরদাস্ত হলেও নৃত্য করা গহিত ছিল, তেমনি ছাত্রদের বেলায় গদ্যরচনা সহ হলেও কবিতা ছিল চরিত্রহানিকর। তা ছাড়া কবিতার বিষয়গুলিও খুব স্বর্গীয় ছিল না, যদিও একটা কবিতা স্বর্গীয় প্রেম নিয়ে লিখেছিলাম। কিন্তু পণ্ডিত মশাইর কি আশ্চর্য ঔদার্য! পঙ্গু ছন্দ, অপাঙক্তেয় বিষয়, সঙ্কুচিত কল্পনা-তবু যা একটু পড়েন, তাই বলেন চমৎকার। বলেন, লিখে যাও, থেমো না, নিশ্চিতরূপে অবস্থান কর। যা নিশ্চিতরূপে অবস্থান তারই নাম নিষ্ঠা। আর, শোনো— কাছে ডেকে নিলেন। হিতৈষী আত্মজনের মত বললেন, কিন্তু পরীক্ষা কাছে, ভুলো না