আকাশের দিকে চেয়ে মনে হল, ঝড় আসা বিচিত্র নয়। সমস্ত আকাশের রং পাংশু-পিঙ্গল, ঈশান কি নৈঋত কি একটা কোণে হিংস্র শ্বাপদের মত একরাশ ঘোর কালো মেঘ শিকারের ওপর লাফিয়ে পড়বার আগের মুহূর্তের মতই ওৎ পেতে বসেছে। তীরে গাছের পাতা স্পন্দহীন, কেবল ষ্টিমারের আশপাশ ঘুরে গাংচিলের ওড়ার আর বিরাম নেই! চারদিকে কেমন একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা থমথম করছে।
হঠাৎ চোখে পড়ল একটি লোক আমার পাশ কাটিয়ে ফিমেলকম্পার্টমেন্টের ধারে গিয়ে আপদি গ্রীবা সতরঞ্চি মুড়ি দিয়ে উবু হয়ে বসল। বসে সন্তর্পণে একবার কপালের কেয়ারিতে হাত বুলাতেই চিনতে পারলাম সে পুর্বোক্ত প্রমান জগন্নাথ। হাবভাবে বুঝলাম, শ্ৰীমান ভীত হয়েছেন।
বাইরে তাকিয়ে দেখি কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব ওলটপালট হয়ে গেছে। আকাশ-কোণের শ্বাপদজন্তুটা দেহ-বিস্তার করে আকাশের অর্ধেকের বেশি গ্রাস করে ফেলেছে। অন্ধকারে কিছু চোখে পড়ে না, থেকে-থেকে চারদিক মৃদু আলোক-কম্পনে চমকে-চমকে উঠছে। সে আলোয় ধূসর বৃষ্টি-ধার। ভেদ করে দৃষ্টি চলে না, একটু গিয়েই প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে। শিকার কায়দায় পেয়ে ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন উদ্বিগ্ন আনন্দে গোংরাতে থাকে, সমস্ত আকাশ জুড়ে তেমনি শব্দ হচ্ছে …।
যান যান, আপন-আপন জায়গায় যান। গাদি করবেন না এক মুড়ায়-দ্যাহেন না হালার জা’জ কাইত অইয়া গেছে—
উপদেশ শোনা ও তদনুসারে কাজ করবার মত স্থান ও কাল সেটা নয়, তাই নিজ-নিজ জায়গার ওপর কারো বিশেষ আকর্ষণ দেখা গেল না; যিনি পরামর্শ দিচ্ছিলেন, তাঁরও না।
বাহিরে অষ্ট দিকপালের মাতামাতি সমানে চলছে। অবিরল বৃষ্টি, অশ্রান্ত বিদ্যুৎ, আকাশের অশান্ত সরব আস্ফালন, সমস্ত ডুবিয়ে উন্মত্ত বায়ুর অধীর হুহুঙ্কার। তারই ভেতর দিয়ে আমাদেব একমাত্র আশ্রয়স্থল বাজার্ড ষ্টিমার বাযুতাড়িত হয়ে কোন এক ঝড়ের পাখীর মতই সবেগে ছুটে চলেছে।
হঠাৎ মনে হল কে যেন ডাকছে। কাকে, কে জানে। ওকি,–আমাকেই–
শুনুন একবার এদিকে—
চেয়ে দেখি মেয়ে-কামরার দরজার কাছে দাডিযে বছর বুডিবাইশের একটি সাদাসিধে হিন্দু ঘবের মেয়ে। আমি এগিয়ে যেতেই তিনি ব্যগ্রভাবে বললেন—অবি—অবিনাশবাবুকে ডেকে দেবেন একটু? অবিনাশ বোস। অনেকক্ষণ হল নীচে গেছেন, ফেরেন নি। তিনি আমার স্বামী।
বিধ্বস্ত জনসংঘের মধ্যে হাতড়ে-হাতড়ে অনেক কষ্টে অবিনাশবাবুর সন্ধান পাওয়া গেল। ডেক, সেলুন, হস্পিটাল কোথাও তিনি নেই–জাহাজ ডুবছে—এই মহামারণ দুর্যোগে তিনি শুঁটকি মাছের চাঙারির মধ্যে বসে আছেন নিশ্চিন্ত হয়ে। নিশ্চিন্ত হয়ে? হ্যাঁ, ঘাড় দাবিয়ে উবু হয়ে বসে বিপন্না অপরিচিতার স্বামী অবিনাশ বেসি পাশের একটি অর্ধনগ্ন জোয়ান কুলি-মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাব্যচর্চা করছেন। নিশ্চিন্ততা, না, দুর্যোগ?
মণীশের চেয়েও দীর্ঘকায় আরো একজন সাহিত্যিক ক্ষণকালের জন্যে এসেছিল কল্লোলে, গল্পলেখার উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি নিয়ে। নাম দেবেন্দ্রনাথ মিত্র। কত দিন পরে চলে গেল সার্থক জীবিকার সন্ধানে, আইনের অলি গলিতে। বেীদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওকালতিতে গেল বটে, কিন্তু টিকে ছিল শেষ পর্যন্ত, যত দিন কোল টিকে ছিল। মণীশের সঙ্গেই সে আসে আর আসে সেই উদ্দাম প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে। ছাত্র হিসাবে কৃতী, রসবোধের ক্ষেত্রে প্রধী, চেহারায় সুন্দর-সুঠাম দেবীদাস কল্লোলের বীণার একটি প্রধান তন্ত্রী ছিল। উচ্চ তানের তন্ত্রী সন্দেহ নেই। ঝড়ের ঝংকার নিয়ে আসত, দুর্নিবার আনন্দের ঝড়। নিয়ে আসত অনিয়মের উন্মাদনা। উজরোল, উতরোল, হুল্লোড় পড়ে যেত চারদিকে। দেবীদাস কিন্তু রবাহূত হয়ে আসেনি। এসেছে স্বাধিকারবলে, সাহিত্যিকের ছাড়পত্র নিয়ে। কল্লোলে একবার গল্পপ্রতিযোগিতায় দেবীদাসের গল্পই প্রথম পুরস্কার পায়। যত দূর মনে পড়ে, এক কুষ্ঠরুগী নিয়ে সে গল্প। একটা কালো আতঙ্কের ছায়া সমস্ত লেখাটাকে ঢেকে আছে। সন্দেহ নেই, শক্তিধরের লেখনী।
কল্লোলে ভিড় যত বাড়ছে ততই মেজবৌদির রুটির পাঁজা শীর্ণ হয়ে আসছে—সে জঠরারণ্যের খাণ্ডবদাহ নিবৃত্ত করবার সাধ্য নেই কোনো গৃহস্থের। চঁদা দাও, কে-কে অপারগ হাত তোল, চাঁদায় না কুলোয় ধরে। কোনো ভারী পকেটের খদ্দেরকে। এক পয়সায় একখানা ফুলকো লুচি, মুখভরা সন্দেশ একখানা এক আনা, কাছেই পুঁটিরাম মোদকের দোকান, নিয়ে এস চ্যাঙারি করে। এক চাঙারি উড়ে যায় তো আরেক চাঙারি। অতটা রাজাহার না জোটে, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিটের মোড়ে বুড়ো হিন্দুস্থানীর দোকান থেকে নিয়ে এস ডালপুরি। একটু দগ্ধভক্ষ খাবে নাকি, যাবে নাকি অশাস্ত্রের এলাকায়? অশাসনের দেশে আবার শাস্ত্র কি, শেয়ালদা থেকে নিয়ে এস শিককাবাব। সঙ্গে ছন্দ রেখে মোগলাই পরোটা!
আর, তেমন অশন-আচ্ছাদনের ব্যবস্থা যদি না জোটাতে পারে, চলে যাও ফেভরিট কেবিনে, দু পয়সার চায়ের বাটি মুখে করে অফুরন্ত আড্ডা জমাও।
মির্জাপুর স্ট্রিটে ফেভরিট কেবিনে কল্লোলের দল চা খেত। গোল শ্বেতপাথরের টেবিল, ঘন হয়ে বসত সবাই গোল হয়ে। দোকানের মালিক, চাটগেঁয়ে ভদ্রলোক, নাম যতদূর মনে পড়ে, নতুনবাবু, সুজনসুলভ স্নিগ্ধতায় আপ্যায়ন করত সবাইকে। সে সম্বর্ধনা এত উদার ছিল যে চা বহুক্ষণ শেষ হয়ে গেলেও কোনো সঙ্কেতে সে যতিচিহ্ন আঁকত না। যতক্ষণ খুশি আজ্ঞা চালিয়ে যাও জোর গলায়। কে জানে হয়তো আড়াই আকর্ষণ করে আনবে কোনো কৌতূহলীকে, তৃষার্তচিত্তকে। পানের অভাব হতে পারে কিন্তু স্থানের অভাব হবে না। এখুনি বাড়ি পালাবে কি, দোকান এখন অনেক পাতলা হয়েছে, এক চেয়ারে গা এলিয়ে আরেক চেয়ারে পা ছড়িয়ে দিয়ে বোস। শাদা সিগারেট নেই একটা? অন্তত একটা খাকি সিগারেট?