কালনেমি-র ডাকু জোয়ান মরদ-রেলে কাটা পড়ে কাজের বার হয়ে যায়। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে স্ত্রী ময়নাকে নিয়ে পটলডাঙার ভিখিরিপাড়ায় এসে আস্তানা নেয়। ডাকুকে বোজ রাস্তার মোড়ে বসিয়ে দিয়ে ময়না দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে ভিক্ষের সন্ধানে, ফিরে এসে আবার স্বামীকে তুলে নিয়ে যান। কিন্তু সেই ভিখিরিপাড়ায় স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের কোনো অস্তিত্ব নেই, নিয়ম নেই থাকবার। সেখানে প্রতি বছরই ছেলে জন্মায়, কিন্তু বাপ-মার ঠিক-ঠিকানা জানবার দরকার হয় না। কেউ কারু একলার নয়। ময়না এ জগতে একেবারে বিদেশী, কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারে না। এই বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে। তাই একদিন রতনার আক্রমণে সে রুখে ওঠে।
স্বামীকে গিয়ে বলে—তু একটা বিহিত করবিনে?
একটু চুপ করে থেকে ডাকু তাকে বুকে সাপটিয়ে ধরে। বলেহোকগে। থাকতেই হবে যখন হেতায় তখন কি হবে আর ঘাঁটিয়ে?–আয় তুই … ।
ময়না চারিদিকে তাকিয়ে আশ্রয় খোঁজে। গা ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় স্বামীর কবল থেকে।
ডাকু বলে–চললি কোতা?
রতনার কাছে।
কিন্তু ডাকু তাতে দমে না। বলে-দোহাই তোর, আমাকে একেবারে ফাঁকি দিসনে। একটিবার আসিস রেতে–
গোষ্পদ গল্পে অন্য রকম সুর। একটি ক্ষণকালিক সদিচ্ছার কাহিনী। খেঁদি-পিসি পটলডাঙার ভিখিরিদলের মেয়ে-মোড়ল। একদিন পথে ভঘরের একটি বিবর্জিত বউকে কুড়িয়ে পায়। তাকে নিয়ে আসে বস্তিতে। প্রথমেই তো সে ভিক্ষুকের ছাড়পত্র পেতে পারে ন, সেই শেষ পরিচ্ছেদের এখনো অনেক পৃষ্ঠা বাকি। তাই প্রথমে খেঁদি ধমক দিয়ে উঠল। বললে, আমাদের দলে যাদের দেখলে, সবই ত ওই করত এককালে। পরে, বুড়ো হয়ে, কেউ ব্যায়ামে পড়ে পথে বেরিয়েছে। তোমার এই বয়সে অন চেহারা—তা বাপু, নিজে বোঝ—
মেয়েটি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
এবার আর খেঁদি কান্না শুনে খিটখিট করে উঠল না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে কি ভাবল। হয়তো ভাবল এই অবুঝ মেয়েটাকে বাঁচানো যায় কিনা। যায় না, তবু যত দিন যায়। তাই সে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,-আচ্ছা থাকে। কিন্তু এ চেহারা নিয়ে কলকাতা হেন জায়গায় কি সামলে থাকতে পারবে? আমার খবরদারিতে যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ অবিশ্যি ভয় নেই। কিন্তু সব সময় কি আমি চোখ রাখতে পারব?
না, ভয় নেই। থাকো, কোথায় যাবে এই জঙ্গলে? যতক্ষণ ঘরে খেঁদি আছে ততক্ষণ, ততটুকু সময় তো মেয়েটি নিরাপদ।
মৃত্যুঞ্জয় প্রেমের গল্প-গোবরগাদায় পদ্মফুল। ও-তল্লাটে চঞ্চু সবচেয়ে ঝানু বদমাইস, হৃদয়হীন জানোয়ার। থাকত ক্ষ্যান্তর ঘরে— ক্ষ্যান্ত হচ্ছে খেঁদির ডান-হাত। দলের সেরা হচ্ছে চঞ্চু, তাই তার ডেরাও মজবুত—ক্ষ্যান্তর ঘর। এ হেন চঞ্চু একদিন ময়লা, রোগ। আর বোবা এক ছুঁড়িকে নিয়ে এসে দলে ভর্তি করে দিলে। কিন্তু সেই থেকে, কেন কে জানে, তা আর ভিক্ষেয় বেরোতে মন ওঠে না। শুধু তাই নয়, সেদিন সে পটলাকে চড়িয়ে দিযেছে একটা মেয়ের হাত থেকে বালা ছিনিয়ে নেবার সময় তার আঙুল মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে বলে। চঞ্চুর এই ব্যাপার দেখে সবাই খাপ্পা হযে খেঁদিকে গিয়ে। ধরল। বললে,-এর একটা বিহিত তোকে আজই করতে হবে পিসি। নইলে সব যে যেতে বসেছে। ড্যাকরার কি যে হয়েছে কদিন থেকে সাবুগিরি ফলাতে শুরু করেছে মাইরি।
খেঁদি গিয়ে পড়ল চঞ্চুকে নিয়ে। মুখিয়ে উঠল : বল মুখপোড়া, তুই ভেবেছিস কি? দলের নাম ডোবাতে বসেছিস রে।
চঞ্চু হাঁ-না কোনো জবাব দিল না।
একজন বলল অরে, ও তো এমন ছেল না। ওই শুঁটকি মাগী। এসেই তো ওকে বিগড়েছে! ওকে না তাড়ালে চঞ্চুকে ফেরাতে পারবি না—
খেঁদি বলল, সত্যি করে বল তুই, ও-মাগী তোর কে? আমি কেন, দশজনে দেখছে, ওই তোকে সারছে। ও কে তোর?
বোবা মেযেটাও ইতিমধ্যে এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে। চঞ্চু তার দিকে তাকিয়ে রইল স্পষ্ট করে। বললে, ও আমার বোন।
বোন? খেঁদির দলে বোন? মা-বোনের ছোঁয়াচ তো টের দিনই সবাই এড়িয়ে এসেছে।
–শোন, এই তোকে বলছি—খেঁদি খেঁকিয়ে উঠল—ও মাগীকে তোর ছাড়তে হবে। যেখান থেকে ওকে কুড়িয়ে পেয়েছি, কাল গে সেইখানে রেখে আসবি নইলে
চঞ্চু তাকাল খেঁদির দিকে।
—নইলে দল ছাড়তে হবে তোকে। আগেকার মত যদি হতে পারিস তবেই থাকতে পারবি, নইলে আর নয়। বুঝেছিস?
ভোর রাতের আবছা আলোয় খেঁদি পিসির আস্তানা থেকে বেরিয়ে এল চঞ্চু, সেই বোবা মেয়েটার হাত-ধরা। অনেক দিন চলে গেল, আর তাদের হদিস নেই।
রতন টিপ্পনি কাটল,–বলেছিনু কিনা। শক্ত একট: কিছু বেঁধেছে বাবা। নইলে চঞ্চুর মত স্যায়ন ঘাগী–
তেরোশ বত্রিশের কল্লোলে যুবনাশ্ব তিনটি গল্প লেখে মন্থশেষ, ভুখা ভগবান আর দুর্যোগ। এর মধ্যে দুর্যোগ অপরূপ। পটলডাঙার গল্প নয়, পদ্মার উপরে ঝড় উঠেছে—তার মধ্যে যাত্রীবাহী স্টিমার–বাজার্ডের গল্প। জোরালো হাতে লেখা। কলম যেন ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে।
গতিক বড় সুবিদার জোগন্নাথ, ঝোরি-বিষ্টি আইব মনে হয়। বুচি লো, চুন দে দেহি এট্টু–
সতরঞ্চির ওপর হুঁকো ও গামছা-বাঁধা জলতরঙ্গ টিনের তোরঙে ঠেস দিয়ে আজানু গোলাপী পাঞ্জাবি ও তদুপরি নীল স্ট্রাইপ-দেওয়া টুইলের গলফ-কোট গায়ে একটি বছর সাতাশ-আটাশের মদনমোহন শুয়েছিল। বোধ করি তারই নাম জগন্নাথ। সে চট করে কপালের লতায়িত কেশগুচ্ছের ওপর হাত বুলিয়ে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললে,–
ডাইল! হালায় আপনের যত গাজাখুরি কথা। হুদাহুদি ঝরি আইব ক্যান? আর আহেই যদি হালার ডর কিসের? আমরা ত হালার জাইল্যা ডিঙিতে যাইত্যাছি না।