কষ্টে-ক্লেশে দিন যাচ্ছে, পড়া-থাকার খরচ জোগানো কঠিন, অবন্ধু সংসারের নির্দয় রুক্ষতায় পদে পদে বিপয়, কিন্তু সরসবচনে সুখসৃষ্টিতে আপত্তি কি।
বিজয় হয়তো বললে, সুকুমারটা একটা ফল্স্।
সুকুমার পালটা জবাব দিলে, বিজয়টা একটা বোগাস।
হাসির হল্লোড় পড়ে যেত। ঐ সামান্য দুটো কথায় এত সবার কি ছিল আজকে তা বোঝানো শক্ত। অবিশ্যি উক্তির চেয়ে উচ্চারণের কারুকার্যটাই যে বেশি হাসত তাতে সন্দেহ নেই। তবু আজ ভাবতে অবাক লাগে তখনকার দিনে কত তুচ্ছতম ভঙ্গিতে কত মহত্তম আনন্দলাভের নিশ্চয়তা ছিল। দুটি শব্দ—ইয়ে, আর উহ-বিজয় এমন অদ্ভুতভাবে উচ্চারণ করত যে মনে হত এত সুন্দর রসাত্মক বাক্য বুঝি আর সৃষ্টি হয়নি। নৃপেনকে দেখে নেপোয় মারে দই কিংবা আফজলকে দেখে কেউ যদি বলত ডাজল, নামত অমনি হাসির ধারাবর্ষণ। আজকে ভাবতে হাসি পায় যে হাসি নিয়ে জীবনে তখন ভাবনা ছিল না। বুদ্ধি-বিবেচনা লাগত না যে হাসিটা সত্যিই বুদ্ধিমানের যোগ্য হচ্ছে কিনা। অকারণ হাসি, অবারণ হাসি। কবিতার একটা ভালো মিল দিতে পেরেছি কিংবা মাথায় একটা নতুন গল্পের আইডিয়া এসেছে এই যেন যথেষ্ট সুখ। প্রাণবহনের চেতনায় প্রতিটি মুহূর্ত স্বর্ণঝলকিত। কোন দুর্গম গলির দুর্ভেদ্য বাড়িতে নিভৃত মনের বাতায়নে উদাসীনা প্রেয়সী অবসর সময়ে বসে আছেন এই মান দিগন্তের দিকে চেয়ে—এই যেন পরম প্রেরণা। আয়োজন নেই, আড়ম্বর নেই, উপচার-উপকরণ নেই–একসঙ্গে এতগুলি প্রাণ যে মিলেছি এক তীর্থসতে, জীবনের একটা ক্ষুদ্র ক্ষণকালের কোঠায় খুব ঘেঁসাঘেঁসি করে যে বসতে পেরেছি একাসনে–এক নিমন্ত্রণে—এই আমাদের বিজয়-উৎসব।
সুকুমারের গল্পে নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের সংগ্রামের আভাস ছিল, বিজয়ের গল্প বিশুদ্ধ প্রেম নিয়ে। যে প্রেমে আলোর চেয়ে ছায়া, ঘরে চেয়ে ঘরের কোণটা বেশি স্পষ্ট। যেখানে কথার চেয়ে স্তব্ধতাটা বেশি মুখর। বেগের চেয়ে বিরতি বা ব্যাহতি বেশি সক্রিয়। এক কথায় অপ্রকট অথচ অকপট প্রেম। অল্প পরিসরে সংযত কথায় সূক্ষ্ম আঙ্গিকে চমৎকার ফুটিয়ে তুলত বিজয়। দুটি মনের দুদিকের দুই জানলি কখন কোন হাওয়ায় একবার খুলছে আবার বন্ধ হচ্ছে তার খেয়ালিপনা। দেহ সেখানে অনুপস্থিত, একেবারে অনুপস্থিত না হলেও নিরুচ্চার। শুধু মনের উয়ের ঘূর্ণিপাক। একটি ইচ্ছুক মনের অদ্ভুত ঔদাসীন্য, হয়তো বা একটি উদ্যত মনের অদ্ভুত অনীহা। তেরোশ তিরিশের প্রায় গোড়া থেকেই বিজয় এসেছে কল্লোলে, কিন্তু তার হাত খুলেছে তোরেশ একত্রিশ থেকে। তেরোশ একত্রিশ-বত্রিশে কটি অপূর্ব প্রেমের গল্প সে লিখেছিল। যে প্রেম দূরে-দূরে সরে থাকে তার শূন্যতাটাই সুন্দর, না, যে প্রেম কাছে এসে ধরা দেয় তার পূর্ণতাটাই চিরস্থায়ী—এই জিজ্ঞাসায় তার গল্প গুলি প্রাণস্পন্দী। একটি ভঙ্গুর প্রশ্নকে মনের নানান আঁকাবাঁক গলিঘুজিতে সে খুঁজে বেড়িয়েছে। আর যতই খুঁজেছে ততই বুঝেছে এ গোলকধাঁধার পথ নেই, এ প্রশ্নের জবাব হয় না।
বিজয় কিন্তু আসে মণীশ ঘটকের সঙ্গে। দুজনে বন্ধু ছিল কলেজে, সেই সংসর্গে। একটা বড় রকম অমিল থেকেও বোধহয় বন্ধুত্ব হয়। বিজয় শান্ত, নিরীহ; মণীশ দুর্ধর্ষ, উদ্দাম। বিজয় একটু বা কুনো, মণীশ নির্ধারিত। ছ-ফুটের বেশি লম্বা, প্রস্থে কিছুটা দুঃস্থ হলেও বলশালিতার দীপ্তি আছে তার চেহারায়। অতখানি দৈর্ঘ্যই তো একটা শক্তি। কল্লোলে আত্মপ্রকাশ করে সে যুবনাশ্বের ছদ্মনাম নিয়ে। সেদিন যুবাশ্বের অর্থ যদি কেউ করত জোয়ান ঘোড়, তাহলে খুব ভুল করত না, তার লেখায় ছিল সেই উদ্দীপ্ত সবলতা। কিন্তু এমন বিষয় নিয়ে সে লিখতে লাগল যা মান্ধাতার বাপের আমল থেকে চলে এলেও বাংলাদেশের সুনীতি সত্যের মেম্বাররা দেখেও চোখ বুজে থাকছেন। এ একেবারে একটা নতুন সংসার, অধন্য ও অকৃতার্থের এলাকা। কাণা খোঁড়া ভিক্ষুক গুণ্ডা চোর আর পকেটমারের রাজপাট। যত বিকৃত জীবনের কারখানা। বলতে গেলে, মণীশই কল্লোলের প্রথম মশালচী। সাহিত্যের নিত্যক্ষেত্রে এমন সব অভাজনকে সে ডেকে আনল যা একেবারে অভূতপূর্ব। তাদের একমাত্র পরিচয় তারাও মানুষ, জীবনের দরবারে একই সই-মোহর-মারা একই সনদের অধিকারী। মানুষ? না, মানুষের অপচ্ছায়া? কই তাদের হাতে সেই বাদশাহী পাঞ্জার ছাপ-তোলা নদ? তারা যেসব বিনা টিকিটের যাত্রী। আর, সত্যি করে বলো এটা কি দরবার, না বেচাকেনার মেছোহাটা? তারা তো সব সস্তায় বিকিয়ে যাওয়া ভুষিমাল।
যুবনাশ্বের ঐ সব গল্পে হয়তো আধুনিক অর্থে কোনো সক্রিয় সমাজসচেতনতা ছিল না, কিন্তু জীবন সম্বন্ধে ছিল একটা সহজ বিশালতাবোধ। যে মহৎ শিল্পী তার কাছে সমাজের চেয়েও জীবনই বেশি অর্থান্বিত। যে জীবন ভগ্ন, রুগ্ন, পর্যদস্ত, তাদেরকে সে সরাসরি ডাক দিলে, জায়গা দিলে প্রথম পংক্তিতে। তাদের নিজেদের ভাষায় বলালে তাদের যত দগদগে অভিযোগ, জীবনের এই খলতা এই পঙ্গুতার বিরুদ্ধে কশায়িত তিরস্কার। দেখালে তাদের ঘা, তাদের পাপ, তাদের নিজত। সমস্ত কিছুর পিছনে দয়াহীন দারিদ্র। আর সমস্ত কিছু সত্ত্বেও একটি নিষ্পঙ্ক ও নীরোগ জীবনের হাতছানি।
ভাবতে অবাক লাগে যুবনাশ্বের সেই সব গল্প আজও পর্যন্ত পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি। চব্বিশ বছর আগে বাংলাদেশে এমন প্রকাশক অবিশ্যি ছিল না যে এ গল্পগুলি প্রকাশ করে নিজেকে সম্ভ্রান্ত মনে করতে পারত। কিন্তু আজকে অনেক দৃষ্টিবদল হলেও এদিকে কারু চোখ পড়ল না। ভয় হয়, অগ্রনায়ক হিসেবে যুবনাশ্বের নাম না একদিন সবাই ভুলে যায়। অন্তত এই অগ্রদৌত্যের দিক থেকে এই গল্পগুলি সাহিত্যের ইতিহাসে গণনীয় হয়ে থাকবে। এরাই বাংলা সাহিত্যে নতুন আবাদের বীজ ছড়ালে। বাস্তবতা সম্বন্ধে সরল নির্ভীকতা ও অপধ্বস্ত জীবনের প্রতি সশ্রদ্ধ সহানুভূতি এই দুই মহৎ গুণ তার গল্পে দীপ্তি পাচ্ছে।