বৃহস্পতিবার, বারবেলা
দাদা দীনেশ,
…দু দিন আমি পটুয়াটোলার মোড় থেকে ফিরে এসেছি। জানি, এতে আমার নিজের দোষ কিছু নেই, কিন্তু যে পরাজয়ের লজ্জা আমার অষ্টাঙ্গ বেষ্টন করে ধরেছে তার হাত থেকে আজ পর্যন্ত নিষ্কৃতি পাচ্ছি না যে। আমার মত লোকের বই ছাপানো যে কত দূর অন্যায় হয়েছে তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। তাই সমস্ত বোঝার ভার আপনার ঘাড়ে চড়িয়ে দিয়ে আমি একটুখানি সরে দাঁড়াতে চাই।
এখন কি হয়েছে শুনুন। কাবলিওয়ালার মত তাগাদা দিয়ে রায়-সাহেবের কাছে হাসি লক্ষ্মীর জন্য ৫০০ পাঁচ শ টাকা আদায় করেছি, তার পরেও শ খানেক টাকা বাকী ছিল। এখন তিনি সে টাকা দিতে অস্বীকার করেছেন। কাজেই বোঝা এসে পড়েছে আমার ঘাড়ে। এ নিঃস্ব ভিখারীর পক্ষে শ খানেক টাকার বোঝাও যে ভারী দাদা। কিন্তু এখন আমি করি কি? গত দুদিন আমি বই লিখে প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে উপযাচকের মত একশটি টাকার জন্যে ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু এ অভাগার দুর্ভাগ্য, কারও কাছ থেকে একটা আশ্বাসের বাণীও আমার ভাগ্যে জোটেনি। …আমি এ অন্ধকার আবর্তের মধ্যে পড়ে ভাববার কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
আমায় একবার এ সব দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দিন। লোটা কম্বল সম্বল করে বোম কেদারনাথ বলে আমি একবার বেরিয়ে পড়তে চাই। এ সব সর্বনাশ আবর্জনার মধ্যে প্রাণ আমার সত্যসত্যই ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে।….
হাসি লক্ষ্মীর আবেষ্টনের মধ্যে হাত-পা যেন বাধা হয়ে রয়েছে, তাই কুছ পবোয়া নেই বলতে কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছে। এ বন্ধন থেকে যদি শনিবার দিন মুক্তি পাই তাহলে বুক ঠুকে বলছি–কুছ পরোটা নাই! তাহলে–
সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
মুখ হাসে মোর চোখ হাসে আর টগবগিয়ে খুন হাসে।
লিখেছেন,–হাসছ তো শৈলজা? আঃ, কি আর বোলব ভাই, এমন সান্ত্বনার বাণী অনেকদিন শুনিনি। আজ আমার মনে পড়ছে— সে আজ বহুদিনের কথা—আর একজন, তার নিজের বেদনা বক্ষের গাঢ় বক্তাক্ত ক্ষতমুখ দুহাত দিয়ে বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরে কয়েছিল মেয়েদের মত তোমার এ কান্না সাজে না, তুমি কেঁদো না।
সে কথা হয়ত আজ ভুলে ছিলুম, তাই আমার ক্ষণে-ক্ষণে মনে হয়–
হাসি? হায় সখা, এ তো স্বর্গপুরী নয়,
পুষ্পে কীট সম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়
মৰ্ম্মমাঝে।
আশা করি সকলেই কুশলে আছেন। আমার ভালোবাসা গ্রহণ করুন। শনিবার দিন রিক্তহস্তে এ দীন দীনেশের দরজায় গিয়ে জড়াবে—তার অন্তরের বিরাট ক্ষুধা একটুখানি সহানুভূতির নিবিড় করুণা চাওয়ার প্রত্যাশী!
এই সময় আমি এক টেক্সট-বুক প্রকাশকের নেকনজরে পড়ি। সেই আমার পুস্তক প্রকাশকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকার। অনুরোধ হল, নিচু ক্লাশের স্কুলের ছাত্রদের জন্যে বাঙলায় একখানা রচনা-পুস্তক লিখে দিতে হবে—হাতি-ঘোড় উষ্ট্র-ব্যাঘ্র নিয়ে রচনা। তনখা পঞ্চাশ টাকা। সানন্দচিত্তে রাজি হয়ে গেলাম, প্রায় একটা দাও পাওয়ার মত মনে হল। লেখা শেষ করে দিলাম অল্প কয়েক দিনের মধ্যে —লেখার চেয়েও লেখা শেষ করতে পারাটাই বেশি পছন্দ হল প্রকাশকের। টাকার জন্যে হাত বাড়ালে প্রকাশক মাত্র একটি টাকা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন। বললাম—বাকিটা? আস্তে-আস্তে দেব, বললেন প্রকাশক, একসঙ্গে একমুস্তে সব টাকা দিয়ে দিতে হবে পষ্টাপষ্টি এমন কথা হয়নি। ভালোই তো, অনেক দিন ধরে পাবেন। কিন্তু একদিন এই অনেক দিনের সান্ত্বনাটা মন মেনে নিতে চাইল না। হন্তদন্ত হয়ে দোকানে ঢুকে বললাম, টাকা দিন। প্রকাশক মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, এত হন্তদন্ত হয়ে চলেছেন কোথায়? বললাম, খেলা দেখতে। খেলা দেখতে? যেন আশ্বস্ত হলেন প্রকাশক। সরবে হিসেব করলেন শুনিয়ে-শুনিয়ে গ্যালারি চার আনা আর ট্রাম ভাড়া দশ পয়সা। সাড়ে ছ আনাতেই হবে, সাড়ে ছ আনাই নিয়ে যান! বলে সত্যি-সত্যি সাড়ে ছ আনা পয়সাই গুনে দিলেন।
বাঙলা দেশের প্রকাশকের পক্ষে তখন এও সম্ভব ছিল!
০৯. সান-ইয়াৎ-সেন মানে সনৎ সেন
সান-ইয়াৎ-সেন আসত কল্লোলে। সান-ইয়াৎ-সেন মানে আমাদের সনৎ সেন। সনৎ সেনকে আমরা সান-ইয়াৎ-সেন বলতাম। অৰ্ধাঙ্গিণী নামে একখানা উপন্যাস লিখেছিল বলে মনে পড়ছে। আধপোড় চুরুট মুখে দিয়ে প্রায়ই আসত আড্ডা দিতে, প্রসন্ন চোখে হাসত। দৃষ্টি হয়তো সাহিত্যের দিকে তত নয় যত ব্যবসার দিকে। বাণিজ্যে বাঙ্গালীর স্থান বলে কিছু একটা লিখেওছিল এ বিষয়ে। হঠাৎ একদিন ফাঁসির গোপীনাথ বলে বই বের করে কাণ্ড বাধালে। কল্লোল-আপিসেই কাণ্ড, কেননা কল্লোলই ছিল ঐ বইয়ের প্রকাশক। একদিন লাঠি ও লালপাগড়ির ঘটায় কল্লোল-আপিস সরগরম হয়ে উঠল। জেলে গোপীনাথের যেমন ওজন বেড়েছিল বইএর বিক্রির অঙ্কটা তেমনি ভাবে মোটা হতে পেল না। সরে পড়ল সান-ইয়াৎ সেন। পস্টাপস্টি ব্যবসাতে গিয়েই বাসা নিলে।
কিন্তু বিজয় সেনগুপ্তকে আমরা ডাকতাম কবরেজ বলে। শুধু বদ্যি বলে নয়, তার গায়ের চাদর-জড়ানো বুড়োটে ভারিকিপনা থেকে। এককোণে গা-হাত-পা ঢেকে জড়সড় হয়ে বসে থাকতে ভালবাসত, সহজে ধরা দিতে চাইত না। কিন্তু অন্তরে কাষ্ঠ কার্পণ্য নিয়ে কল্লোলের ঘরে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে এমন তোমার সাধ্য কি। আস্তে-আস্তে সে ঢাকা খুললে, বেরিয়ে এল গাম্ভীর্যের কোটর থেকে। তার পরিহাস-পরিভাষে সবাই পুলকম্পন্দিত হয়ে উঠল। একটি পরিশীলিত সূক্ষ্ম ও স্নিগ্ধ মনের পরিচয় পেলাম। তার জমত বেশি সুকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে। হয়তো দুজনেই কৃষ্ণনগরের লোক এই সুবাদে। বিজয় পড়ছে সিকসথ ইয়ার ইংরিজি, আর সুকুমার এম এস সি আর ল। দুজনেই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট। কিংবা হয়তো আরও গভীর মিল ছিল যা তাদের রসস্ফুর্ত আলাপে প্রথমে ধরা। পড়ত না। তা হচ্ছে দুজনেরই কায়িক দিনযাপনের আর্থিক কৃজ্ঞতা।