মনে আছে এই কবিতা নজরুল কল্লোল-আপিসে বসে লিখেছিল এক বৈঠকে। ঠিক কল্লোল-আপিসে হয়তো নয়, মণীন্দ্রর ঘরে। মণীন্দ্র চাকী কল্লোলের একক কর্মচারী। নীরব, নিঃসঙ্গ। মুখে একটি হ্রস্ব নির্মল হাসি, অন্তরে ভাবের স্বচ্ছতা। ঠিকমত মাইনে-পত্র পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন অভাবের রুক্ষ রাজপথ দিয়ে হাঁটছে। অথচ এক বিন্দু অভিযোগ নেই, অবাধ্যতা নেই। ভাবখানা এমনি, কল্লোলের জন্যে সেও তপশ্চারণ করছে, হাসিমুখে মেনে নিচ্ছে দারিদ্রের নির্দয়তাকে। লেখকরা যেমন এক দিকে সেও তেমনি আরেক দিকে। সে কম কিসে! সে লেখে না বটে কিন্তু কাজ করে, সেবা করে। সেও তো এক নৌকার সোয়ারি।
খোলার চালে ঘুপসি একখানা বিচ্ছিন্ন ঘর ওই মণীন্দ্রর। কল্লোল-আপিসের সঙ্গে শুধু একফালি ছোট্ট একটা গলির ব্যবধান। মণীন্দ্রর ঘর বটে, কিন্তু যে-কাউকে সে যে-কোনো সময় তা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। নিয়মিত সময়ে নজরুল কবিতা লিখে দিচ্ছে না, বন্ধ করো তাকে সেই ঘরে, কবিতা শেষ হলে তবে খুলে দেয়া হবে ছিটকিনি। কাশী থেকে দৈবাৎ সুরেশ চক্রবর্তী এসে পড়েছে, থাকবার জায়গা নেই, চলে এস মণীন্দ্রর ঘরে। প্রেমেন এসেছে ছুটিতে, মেসের দরজা বন্ধ তো মণীন্দ্রর দরজা খোলা। দুপুরবেলা ব্রে খেলতে চাও—সেই কালো বিবি-গছানো কালান্তক খেলা—চলে যাও মণীন্দ্রর আস্তানায়। চারজনের মামলায় ষোলোজন মোক্তারি করে হুল্লোড় বাধাও গে। কখন হঠাৎ শুনতে পাবে তোমার পাশের থেকে আশু ঘোষ লাফিয়ে উঠেছে তারস্বরে : আহাহাহা, করস কি, দুরির উপর তিনি মারিয়া দে–
গুপ্ত ফ্রেণ্ডস-এর আশু ঘোষ! কি সুবাদে যে কল্লোলে এল কে বলবে। কিন্তু তাকে ছাড়া কোনো আড়াই যেন দানা বাঁধে না। একটা নতুন স্বাদ নিয়ে আসত, ঋজু ও দৃপ্ত একটা কাঠিন্যের স্বাদ। নির্ভীক সারল্যের দারুচিনি। আশুকে কোনোদিন পাঞ্জাবি গায়ে দিতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না–শার্ট-কোট তো সুদূরপরাহত। চিরকাল গেঞ্জি-গায়েই আনাগোনা করল, খুব বেশি শালীনতার প্রয়োজন বোধ করলে পাঞ্জাবিটা বড়জোর কাঁধের উপর স্থাপন করেছে। আদর্শের কাছে অটলপ্রতিজ্ঞ আশু ঘোষ, পোশাকেও দৃঢ়পিনদ্ধ। অল্পেই সন্তুষ্ট তাই পোশাকেও যথেষ্ট। তার প্রীতির উৎসারই হচ্ছে তিরস্কারে—আর সে কি ক্ষমাহীন নির্মম তিরস্কার! কিন্তু এমন আশ্চর্য, তার কশাঘাতকে কশাঘাত মনে হত না, মনে হত রসাঘাত,–যেন বিদ্যুতের চাবুক দিয়ে মেঘ তাড়িয়ে রোদ এনে দিচ্ছে। খাঁটি, শক্ত ও অটুট মানুষের দরকার ছিল কল্লোলে।
আশু ঘোষের গেঞ্জিও যা, দীনেশরঞ্জনের ফ্রিল-দেয়া হাতা-ওয়ালা পাঞ্জাবিও তাই। দুইই এক দুদিনের নিশানা। আমাদের তখন এমন অবস্থা, একজনে এক পুরো আস্ত একটা সিগারেট খাওযা নিষিদ্ধ ছিল। কাঁচি, এবং আরো কাঁচি চললে, পাসিং শো। সিগারেট বেশির ভাগ জোগাত অজিত সেন, জলধর সেনের ছেলে। কল্লোলের একটি নিটুট খুঁটি, তক্তপোশের ঠিক এক জায়গায় গ্যাঁট-হয়ে বসা লোক। কথায় নেই হাসিতে আছে, আর আছে সিগারেট বিতরণে। কুণ্ঠা আছে একটু, কিন্তু কৃপণতা নেই। সবাই দাদা বলতাম তাকে। আশ্চর্য, জলধর সেনকেও দাদা বলতাম। আই-সি-এসের ছেলে আই-সি-এস হয়েছে একাধিক, কিন্তু দাদার ছেলের দাদা হওয়া এই প্রথম। যেমন কুলগুরুর ছেলে কুলগুরু। নিয়ম ছিল সিগারেট টানতে গিয়ে যেই গায়ের লেখার প্রথম অক্ষরটুকু এসে ছোঁবে অমনি আরেকজনকে বাকি অংশ দিয়ে দিতে হবে। পরবর্তী লোক জিতল বলে সন্দেহ করার কারণ নেই, কারণ শেষ দিকে খানিকটা ফেলা যাবে অনিবার্য। তবে পরবর্তী লোক যদি পিন ফুটিয়ে ধরে টানতে পারে শেষাংশটুকু, তবে তার নির্ঘাৎ জিত।
এ দিনের দৈন্যের উদাহরণস্বরূপ দুটো চিঠির টুকরো তুলে দিচ্ছি। একটা প্রেমেনের, আমাকে লেখা :
কিন্তু সুখের বা দুঃখের বিষয় হোক, Testএ পাশ হয়ে গেছি সসম্মানে। এখন ফি-এর টাকা জোগাড় করে উঠতে পারছি না। তাই আজ সকালে তোক চিঠি লিখতে বসব এমন সময় তোর চিঠি এল। এবার তুই কোন ওজর দেখাতে পাবিনা। যা করে হোত, দশটা টাকা আমাকে পাঁচ দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দিবি। আমি পরে কলকেতায় গিয়ে শোধ করব। সত্যি জানিস Testএর ফি দিতে পারছি না। কলকেতায় দিদিমার কাছে একটি পয়সা নেই, এখন বুড়িকে বিড়ম্বিত করাও যায় না। এ সম্বন্ধে আর বেশী কিছু লিখলাম না, তোর যা সাধ্য তা তুই করবি জানি। তোর ভরসায় রইলাম।
Finalএ পাশ হব কি না জানি না, কিন্তু ছুটি যে একেবারে নেব, খাব কি? একটা কথা আমি ভালোরকমেই জানি যে দারিদ্র সমস্ত idealismকে শুকিয়ে মারতে পারে। আমি বড়লোক হতে মোটেই চাই না, কিন্তু অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম আর সাহিত্যসৃষ্টি এই দুকাজ একসঙ্গে করবার মত প্রচুর শক্তি আমার নেই। সে আছে যার সেই মহাপুরুষ শৈলজাকে আমি মনে-মনে প্রায় প্রণাম করে থাকি।
এবার কলকেতায় গিয়ে যদি গোটা ত্রিশ টাকা মাইনের এমন একটা কাজ পাই যাতে অতিরিক্ত একঘেয়ে খাটুনি নেই, তা হলে আমি তাতেই লেগে যাব এবং তাহলে আমার একরকম চলে যাবে। কোনো স্কুলের Librarian-মত হতে পারলে মন্দ হয় না। অবশ্য কেরানীগিরি আমার পোষাবে না।
শরীর ভালো নয়। ঢাকার জল হাওয়া মাটি মানুষ কিছুই ভালো। লাগছে না। হয়তো জীবনের উপরই বিতৃষ্ণার এই সূচনা।
আরেকটা শৈলজার চিঠি, দীশেরঞ্জনকে লেখা :