সেই হরিহরের ঘরে সভা বসেছে। দীর্ঘদীপিতদেহা কয়েকজন সুন্দরী মহিলা আছেন। গান হচ্ছে মধুকণ্ঠে। এমন সময় আবির্ভাব হল নজরুলের। পরনে সেই রঙের ঝড়ের পোশাক। আর কথা কি, হার্মোনিয়ম এবার নজরুলের একচেটে। নজরুল টেনে নিল হার্মোনিয়ম, মহিলাদের উদ্দেশ করে বললে, ক্ষমা করবেন, আপনারা সুর, আমি অসুর।
হেসে উঠল সবাই। অসুরের সুরে ঘর ভরে উঠল।
যতদূর মনে পড়ে সেই সভায় উমা গুপ্ত ছিলেন। যেমন মিঠে চেহারা তেমনি মিঠে হাতে কবিতা লিখতেন তিনি। তিনি আর নেই এই পৃথিবীতে। জানি না তার কবিতা কটিও বা কোনখানে পড়ে আছে।
এই অস্থির এলোমেলেমি নজরুলের শুধু পোশাকে-আশাকে নয়, তার লেখায়, তার সমস্ত জীবনযাপনে ছড়িয়ে ছিল। বন্যার তোড়ের মত সে লিখত, চেয়েও দেখত না সেই বেগ-প্রাবল্যে কোথায় সে ভেসে চলেছে। যা মুখে আসত তাই যেমন বলা তেমনি যা কলমে আসত তাই সে নির্বিরোধে লিখে যেত। স্বাভাবিক অসহিষ্ণুতার জন্যে বিচার করে দেখত না বর্জন-মার্জনের দরকার আছে কি না। পুনর্বিবেচনায় সে অভ্যস্ত নয়। যা বেরিয়ে এসেছে তাই নজরুল, কুবলা খান-এ যেমন কোলরিজ। নিজের মুখে কারণে অকারণে সে স্নো ঘসত খুব, কিন্তু তার কবিতার এতটুকু প্রসাধন করতে চাইত না। বলত, অনেক ফুলের মধ্যে থাক না কিছু কাঁটা, কণ্টকিত পুষ্পই ত নজরুল ইসলাম। কিন্তু মোহিতলাল তা মানতে চাইতেন না। নজরুলের গুরু ছিলেন এই মোহিতলাল। গজেন ঘোষের বিখ্যাত আড্ডা থেকে কুড়িয়ে পান নজরুলকে। দেখেন উদ্বেলতা যেমন আছে আবিলতাও কম নয়। স্রোতশক্তিকে ফলদায়ী করতে হলে তীরের বন্ধন আনতে হবে, আনতে হবে সৌন্দর্য আর সংযম, জাগ্রত বুদ্ধির বশে আনতে হবে ভাবের উদ্দামতাকে। এই বুদ্ধির দীপায়নের জন্যে চাই কিছু পড়াশোনা–অনুভূতির সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ। নিজের পরিবেষ্টনের মাঝে নিয়ে এলেন নজরুলকে। বললেন, পড়ো শেলি-কীটস, পড়ো বায়রন আর ব্রাউনিং। দেখ কে কি লিখেছে, কি ভাবে লিখেছে, মনে স্থৈর্য আনো, হও নিজে নিজের সমালোচক, কল্পনার সোনার সঙ্গে চিন্তার সোহাগ মেশাও। দে গরুর গা ধুইয়ে–নজরুল থোড়াই কেয়ার করে লেখাপড়া। মনের আনন্দে লিখে যাবে সে অনর্গল, পড়বার বা বিচার করবার তার সময় কই। খেয়ালী সৃষ্টিকর্তা মনের আনন্দে তৈরি করে ছেড়ে দিয়েছে গ্রহ-নক্ষত্রকে, পড়ুয়া জ্যোতিষীরা তার পর্যালোচনা করুক। সেও সৃষ্টিকর্তা।
ভাবের ঘরে অবনিবনা হয়ে গেল। কোনো বিশেষ এক পাড়া থেকে নজরুল-নিন্দা বেরুতে লাগল প্রতি সপ্তাহে। ১৩৩-এর কার্তিকের কল্লোলে নজরুল তার উত্তর দিলে কবিতায়। কবিতার নাম সর্বনাশের ঘণ্টা :
রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা,
রুধির-নদীর পার হতে ঐ ডাকে বিপ্লব-হ্রেষা।
হে দ্রোণাচাৰ্য! আজি এই নব জয়-যাত্রার আগে
দ্বেষ-পঙ্কিল হিয়া হতে তব শ্বেত পঙ্কজ মাগে
শিষ্য তোমার; দাও গুরু দাও তব রূপ-মসী ছানি
অঞ্জলি ভরি শুধু কুৎসিত কদর্যতার গ্লানি।…
চিরদিন তুমি যাহাদের মুখে মারিয়াছ ঘৃণা-ঢেলা
যে ভোগানন্দ দাসেদের গালি হানিয়াছ দুই বেলা,
আজি তাহাদের বিনামার তলে আসিয়াছ তুমি নামি,
বাঁদরেরে তুমি ঘৃণা করে ভালবাসিয়াছ বাঁদরামি।
হে অস্ত্র-গুরু! আজি মম বুকে বাজে শুধু এই ব্যথা,
পাণ্ডবে দিয়া জয়-কেতু হলে কুক্কুর-কুরু নেতা।
ভোগ-নরকের নারকীর দ্বারে হইয়াছ তুমি দ্বারী
ব্রহ্ম অস্ত্র ব্রহ্ম দৈত্যে দিয়া হে ব্রহ্মচারী!
তোমার কৃষ্ণ রূপ-সরসীতে ফুটেছে কমল কত,
সে কমল ঘিরি নেচেছে মরাল কত সহস্র শত,
কোথা সে দীঘির উচ্ছল জল কোথা সে কমল রাঙা,
হেরি শুধু কাদা, শুকায়েছে জল, সরসীর বাঁধ ভাঙা।…
মিত্র সাজিয়া শত্রু তোমারে ফেলেছে নরকে টানি
ঘৃণার তিলক পরাল তোমারে স্তাবকের শয়তানী!
যাহারা তোমারে বাসিয়াছে ভালো করিয়াছে পূজা নিতি
তাহাদের হানে অতি লজ্জায় ব্যথা আজ তব স্মৃতি।…
আমারে যে সবে বাসিয়াছে ভালো, মোর অপরাধ নহে,
কালীয়দমন উদিয়াছে মোর বেদনার কালীদহে–
তাহার দাহ তো তোমারে দহেনি, দহেছে যাদের মুখ
তাহারা নাচুক জুলুনীর চোটে। তুমি পাও কোন সুখ
দগ্ধমুখ সে রাম-সেনাদলে নাচিয়া হে সেনাপতি,
শিবসুন্দর সত্য তোমার লভিল এ কি এ গতি?…
তুমি ভিড়িওনা গো-ভাগাড়ে-পড়া চিল শকুনের দলে
শতদলদলে তুমি যে মরাল শ্বেত সায়রের জলে।
ওঠ গুরু, বীর, ঈর্ষা-পঙ্ক-শয়ন ছাড়িয়া পুনঃ,
নিন্দার নহ নানীর তুমি, উঠিতেছে বাণী শুন–
উঠ গুরু উঠ, লহ গো প্রণাম বেঁধে দাও হাতে রাখী,
ঐ হের শিরে চক মারে বিপ্লব-বাজপাখী!
অন্ধ হয়ো না, বেত্র ছাড়িয়া নেত্ব মেলিয়া চাহ
ঘনায় আকাশে অসন্তোষের বিদ্রোহ-বারিবাহ।
দোতলায় বসি উতলা হয়ো না শুনি বিদ্রোহ-বাণী
এ নহে কবির, এ কাঁদন ওঠে নিখিল-মৰ্ম্ম হানি।…
অর্গল এঁটে সেথা হতে তুমি দাও অনর্গল গালি,
গোপীনাথ ম’ল? সত্য কি? মাঝে মাঝে দেখো তুলি জালি।
বরেন ঘোষের দ্বীপান্তর আর মির্জাপুরের বোমা
লাল বাংলার হুমকানী—ছি ছি এত অসত্য ওমা,
কেমন করে যে রটায় এ সব ঝুটা বিদ্রোহী দল!
সখী গো আমায় ধর ধর! মাগো কত জানে এরা ছল!…
এই শয়তানী ক’রে দিনরাত বল আর্টের জয়,
আর্ট মানে শুধু বাঁদরামি আর মুখ-ভ্যাঙচানো নয়।…
তোমার আর্টের বাঁশরীর সুরে মুগ্ধ হবে না এরা
প্রয়োজন-বাঁশে তোমার আর্টের আর্টশালা হবে নেড়া।…
যত বিদ্রূপই কর গুরু তুমি জান এ সত্য বাণী
কারুর পা চেটে মরিব না, কোনো প্রভু পেটে লাথি হানি
ফাটিবে না পিলে, মরিব যেদিন মরিব বীরের মত
ধরা মার বুকে আমার রক্ত রবে হয়ে শাশ্বত।
আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস
ততদিন গুরু সকলের সাথে করে নাও পরিহাস!