সেই সাড়াটা কল্লোলের লেখকদের মধ্যেও এসে গেল। চিন্তায় ও প্রকাশে এল এক নতুন বিরুদ্ধবাদ। নতুন দ্রোহবাণী। সত্যভাষণের তীব্র প্রয়োজন ছিল যেমন রাজনীতির ক্ষেত্রে, তেমনি ছিল অচলপ্রতিষ্ঠ স্থবির সমাজের বিপক্ষে।
০৮. প্রমথ চৌধুরী সরে-আসা মানুষ, দ্বিতীয় নজরুল
কল্লোলকে নিয়ে যে প্রবল প্রাণোচ্ছাস এসেছিল তা শুধু ভাবের দেউলে নয়, ভাষারও নাটমন্দিরে। অর্থাৎ কল্লোলের বিরুদ্ধতা শুধু বিষয়ের ক্ষেত্রেই ছিল না, ছিল বর্ণনার ক্ষেত্রে। ভঙ্গি ও আঙ্গিকের চেহারায়। রীতি ও পদ্ধতির প্রকৃতিতে। ভাষাকে গতি ও ভাবকে দ্যুতি দেবার জন্যে ছিল শব্দসৃজনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রচনাশৈলীর বিচিত্রতা। এমন কি, বানানের সংস্করণ। যারা ক্ষুদ্বপ্ৰাণ, মূঢ়মতি, তারাই শুধু মামুলি হবার পথ দেখে—আরামরমণীয় পথ–যে পথে সহজ খ্যাতি বা:কোমল সমর্থন মেলে, যেখানে সমালোচনার কাঁটা-খোঁচা নেই, নেই বা নিন্দার অভিনন্দন। কিন্তু কল্লোলের পথ সহজের পথ নয়, স্বকীয়তার পথ।
কেননা তার সাধনাই ছিল নবীনতার, অনন্যতার সাধনা। যেমনটি আছে তেমনটিই ঠিক আছে এর প্রচণ্ড অস্বীকৃতি। আছে তার ছেয়েও আরো কিছু আছে, বা যা হয়েছে তা এখনো পুরোপুরি হয়নি তারই নিশ্চিত আবিষ্কার।
এই আবিষ্কারের প্রথম সহায় হলেন প্রমথ চৌধুরী। সমস্ত কিছু সবুজ ও সজীবের যিনি উৎসাহল। মাঝে-মাঝে সকালবেলা কেউকেউ যেতাম আমরা তার বাড়িতে, মে-ফেয়ারে। কল্লোলের প্রতি অত্যন্ত প্রসন্নপ্রয় ছিলেন বলেই যখনই যেতাম, সম্বর্ধিত হতাম। প্রতিভা-ভাসিত মুখ মেহে সুকোমল হয়ে উঠত। বলতেন, প্রবাহই হচ্ছে পবিত্রতা—স্রোত মানেই শক্তি। গোড়ায় আবিলতা তো থাকবেই, স্রোত যদি থাকে তবে নিশ্চয়ই একদিন খুঁজে পাবে নিজের গভীরতাকে।
মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করতাম, লিখে যাব আমরণ। অমন বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে বসে অমন প্রতিজ্ঞা করার সাহস আসত।
বলতেন, এমন ভাবে লিখে যাবে যেন তোমার সামনে আর কেউ দ্বিতীয় লেখক নেই। কেউ তোমার পথ বন্ধ করে বসে থাকেনি। লেখকের সংসারে তুমি একা, তুমি অভিনব।
আমার সামনে আর কেউ বসে নেই? চমকে উঠতাম।
না।
রবীন্দ্রনাথ?
রবীন্দ্রনাথও না! তোমার পথের তুমিই একমাত্র পথকার। সে তোমারই একলার পথ। যতই দল বাঁধো প্রত্যেকে তোমরা একা।
মনে বোমাঞ্চ হত। কথাটার মাঝে একটা আশীর্বাদের স্বাদ পেতাম।
বলেই ফের জের টানতেন : নিত্য তুমি খেল যায়, নিত্য ভাল নহে তাহা, আমি যা খেলিতে বলি সে খেলা খেলাও হে। এ কথা। ভারতচন্দ্র লিখেছিল। চাই সেই শক্তিমান সৃষ্টিকর্তার কতৃত্ব, সেই অনন্তপূর্ব। যদি সর্বক্ষণ মনে কর, সামনে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন, তবে নিজের কথা আর বলবে কি করে? তবে তো শুধু রবীন্দ্রনাথেরই ছায়ানুসরণ করবে। তুমি ভাববে তোমার পথ মুক্ত, মন মুক্ত, তোমার লেখনী তোমার নিজের আজ্ঞাবহ।
রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে এসেছিল কল্লোল। সরে এসেছিল অপজাত ও অবজ্ঞাত মনুষ্যত্বের জনতায়। নিম্নগত মধ্যবিত্তদের সংসারে। কয়লাকুঠিতে, খোলার বস্তিতে, ফুটপাতে। প্রতারিত ও পরিত্যক্তের এলেকায়।
প্রমথ চৌধুরী প্রথম এই সরে-আসা মানুষ। বিষয়ের দিক থেকে না হোক, মনোভঙ্গি ও প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে। আর দ্বিতীয় মানুষ নজরুল।
যেমন লেখায় তেমনি পোশাকে-আশাকেও ছিল একটা রঙিন উচ্ছৃলতা। মনে আছে, অভিনবত্বের অঙ্গীকারে আমাদের কেউ-কেউ তখন কোঁচা না ঝুলিয়ে কোমরে বাঁধ দিয়ে কাপড় পরতাম—পাড়-হীন খান ধুতি—আর পোশাকের পুরাতন দারিদ্র্য প্রকট হয়ে থাকলেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হতাম না। নৃপেন তো মাঝে মাঝে আলোয়ান পরেই চলে আসত। বস্তুত পোশাকের দীনতাটা উদ্ধতিরই উদাহরণ বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু নজরুলের ঔদ্ধত্যের মাঝে একটা কবিতার সমারোহ ছিল, যেন বিহ্বল, বর্ণাঢ্য কবিতা। গায়ে হলদে পাঞ্জাবি, কাঁধে গেরুয়া উড়ুনি। কিংবা পাঞ্জাবি গেরুয়া, উড়ুনি হলদে। বলত, আমার সন্ত্রান্ত হবার দরকার নেই, আমার বিভ্রান্ত করবার কথা। জমকালো পোশাক না পরলে ভিড়ের মধ্যে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব কি করে?
মিথ্যে কথা। পোশাকের প্রগলভতার দরকার ছিল না নজরুলের। বিস্তীর্ণ জনতার মাঝেও সহজে চিহ্নিত হত সে, এত প্রচুর তার প্রাণ, এত রোধবন্ধহীন তার চাঞ্চল্য। সব সময়ে উচ্চরোলে হাসছে, ফেটে পড়ছে উৎসাহের উচ্ছৃলতায়। বড়-বড় টানা চোখ, মুখে সবল পৌঁরুষের সঙ্গে শীতল কমনীয়তা। দূরে থাকলেও মনে করিয়ে দেবে অন্তরের চিরন্তন মানুষ বলে। রঙ শুধু পোশাকে কি, রঙ তার কথায় তার হাসিতে তার গানের অজস্রতায়।
হরিহর চন্দ্র তখন বিশ্বভারতীর সহ-সম্পাদক, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে তার আপিসের দোতালায় ফোর আর্টস ক্লাবের বার্ষিক উৎসব হচ্ছে। হরিহর আর কল্লোল প্রায় হরিহর আত্মার মত। সুগোর সুন্দর চেহারা–পরিহাসচ্ছলে কেউ-কেউ বা ডাকত তাকে রাঙাদিদি বলে। তার শ্ৰী অশ্রু দেবী আসলে কিন্তু আনন্দ দেবী। স্বামী-স্ত্রীতে মিলে আনন্দ মেলা নিয়ে মেতে থাকত। ছোট বড় ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেলাধুলা ও নাচগানের আসরই নামান্তরে আনন্দ মেলা। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে, রামমোহন লাইব্রেরিতে বা মার্কাস স্কোয়ারে এই মেলা বসত, কল্লোলের দল নিমন্ত্রিতদের প্রথম বেঞ্চিতে। কেননা হরিহর কল্লোল-দলের প্রথমাগতদের একজন, তাই কল্লোল প্রথমাত্মীয় নামধেয়। গ্রাহক ও বিজ্ঞাপন জোগাড় করে, প্রুফ দেখে দিয়ে কত ভাবে যে দীনেশ-গোকুলকে সাহায্য করত ঠিক-ঠিকানা নেই। ব্যবহারে প্রীতির প্রলেপ, সৌজন্যের স্নিগ্ধতা—একটি শান্ত, দৃঢ়, সুস্থ মনের সৌরভ ছোত চারদিকে।