কি জানি কতদূর হবে। যদি না থাকি!
আহা, বাঁচুক তারা যারা আসছে। বেচারারা কিছু জানে না, বিশ্বাস ভাঙিয়ে সাদা মনের সওদা কিনতে গিয়ে কিনছে কেবল ফুটো আর পচা! তারা যে তখন কাঁদবে। আহা, যদি তাদের মধ্যে এমন কেউ থাকে যে সে ভেঙে পড়বে, পৃথিবীকে অভিশাপ দিয়ে ফেলবে? না, না, তাদের জন্য কিছু রেখে যেতে পারব না আমরা কজনে?
পলিটিক্স বুঝি না, ধর্ম মানি না, সমাজ জানি না—মানুষের মনগুলি যদি সাদা থাকে—ব্যস, তা হলেই পরমার্থ।
তোমাকে একটা কথা বলছি কানে-কানে। মনটার জন্য একটা চাবুক কেনো। চাবুক মেরো না যেন কখনও, তাহলে বিগড়ে যাবে। মাঝে-মাঝে কেবল সপাং-সপাং করে আওয়াজ করবে-মনের ঘরের যে যেখানে ছিল দেখবে সব এসে হাজির। ভয়ও না ভাঙে, ভয়ও না থাকে–এমনি করে রাখতে হবে।
আর একটা কথা—ভালবাসাটাকে খুঁজে বেড়িও না। ওটা ঘোড়ার গায়ের নালও নয় আর মাটির তলায় মোহরের কলসীও নয়। হাতড়ে চললেই হোঁচট খাবে। তবে কোথায় আর কবে সত্যিকারের ভালবাসবার মত ভালবাসাটুকুকে পাবে তা জানবার চেষ্টাও করো না। খানেখানে পাওয়া যায়—সবটুকু রসগোল্লায় মত একজায়গার তাল পাকিয়ে বসের গামলায় ভাসেনা।
ঝড়ের দিনে শিল কুড়োয়না ছেলেমেয়েরা? কুড়োতে-কুড়োতে দু একটা মুখেই দিয়ে ফেলে আর সব জড় করে একটা তাল পাকায়, সেটা আর চোষে না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আর দেখে। কত রঙের খেলা। ঘুরতে থাকে—আর মাঝে-মাঝে ঠাণ্ডা হাত নিজেরই কপালে চোখে বুলোয়। কুড়েবার সময়ও ঝড়ের যেমন মাতন, যারা শিল কুড়োয় তাদেরও তেমনি ছুটোছুটি হট্টগোল! কোনটা ঠকাস করে মাথায় পড়ে, কোনটা পায়ের কাছে ঠিকরে পড়ে গুড়িয়ে যায়, কোনটা বা এক ফাঁকে গলার পাশ দিয়ে গলে গিয়ে বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কুড়োনো শেষ হলে আর গোল থাকে না, সব চুপচাপ করে তাল পাকায় আর নিজের সংস্থান ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে।
বিয়ে করতে চাও? চাকরী দেখ। অন্ততঃপক্ষে দেড়শ টাকাঙ্কমে হবেই না। তা-ও নেহাৎ দরিদ্রমতে-প্রেম করা চলবে না। যদি সমাজকে ডিঙিয়ে যেতে চাও তাহলে অন্তত দুশো আড়াই শো।
শরীরের খবর দিও। লেখা immediately পাঠাবে। দেরী করোই না। ভালবাসা জেনো।
তোমাদের দীনেশদা
এর দিন কয়েক পরে গোকুলের চিঠি পাই।
কল্লোল
১০-২ পটুয়াটোলা লেন, কলিকাতা
১১ই কার্তিক, ৩১
স্নেহাস্পদেষু
তোমার চিঠি যখন পাই তখন উত্তর দেবার অবস্থা আমার ছিল না। অবস্থা যখন ফিরে পেলাম তখন মনে হল—কি লিখব? লেখবার কিছু আছে কি? চোখের সামনে বসে পবিত্র পাতার পর পাতা তোমায় লিখেছে দেখেছি, ভূপতি নাকি এক ফর্মা ওজনের এক চিঠি লিখেছে, দীনেশ ও সম্ভবত তাই। আর কে কি করেছে তা তুমিই জান, কিন্তু আমার বেয়াদবি আমার কাছেই অসহ্য হয়ে উঠছিল। তাই আজ ভোরে উঠেই তোমাকে লিখতে বসেছি। আমার শরীর এখন অনেকটা ভাল। তোমার প্রথমকার লেখা চিঠিগুলো থেকে যেকথা আমার মনে হয়েছিল তোমার পবিত্রকে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে ঠিক সেই সুরটি পেলাম না। কোথায় যেন একটু গোল আছে। প্রথমে পেয়েছিলাম তোমার জীবনের পূর্ণ বিকাশের আভাস, কিন্তু দ্বিতীয়টা অত্যন্ত melodramatic. দেখ অচিন্ত্য, যে বলে দুঃখকে চিনি, সে ভারী ভুল করে। অনেক দুঃখ পেয়েছি জীবনে কথাটার সুর অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। মনের যে কোন বাসনা ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি অতৃপ্ত থাকলেই যে অশান্তি আমরা ভোগ করি তাকেই বলি দুঃখ, কিন্তু বাস্তবিক ও দুঃখ নয়। যে বুকে দুঃখের বাসা সে বুক পাথরের চেয়েও কঠিন, সে বুক ভাঙ্গে না টলে না। দুঃখের বিষদাত ভেঙ্গে তাকে নির্বিষ করে যে বুকে রাখতে পারে সেই যথার্থ দুঃখী। ভিখারী, প্রতারিত, অবমানিত, ক্ষুধার্ত—এরা কেউই দুঃখী নয়। খৃষ্ট দুঃখী ছিলেন না, তিনি চিরজীবন চোখের জল ফেলেছেন, নালিশ করেছেন, অভিশাপ দিয়েছেন, অভিমান করেছেন। গান্ধী যথার্থ দুঃখী। এবার ক্ষুধা, অশান্তি, ব্যথার প্রত্যেকটি stage-এর সঙ্গে মিলিয়ে নাও, বুঝতে পারবে দুঃখ কত বড়। সবাই যে কবি হতে পারেনা তার কারণ এই গোড়ায় গলদ। অত্যন্ত promising হয়েও melodramatic monologue-এর সীমা এড়িয়ে যেতে পারে না। প্রত্যেক ব্যক্তিগত অতৃপ্তি ও অশান্তির ফর্দ করে যায়, তাই সেটাকে মানুষ বলে সখের দুঃখ। যাক বাজে কথা, কতকগুলো খবর দিই।
হঠাৎ কেন জানি না পুলিশের কৃপাদৃষ্টি আমাদের উপর পড়েছে, আমাদের আপিস দোকান সব খানাতল্লাস হয়ে গেছে, আমরা সবাই এখন কতকটা নজরবন্দী–1818 Act 3 তে।
নৃপেন বিজলী আপিসে কাজ করছে। শৈলজার বাংলার মেয়ে বেরিয়েছে, সে এখন ইকড়ায়। মুরলীর জ্বর হয়েছিল। প্রেমেনের অসমাপ্ত আমি পড়েছি, সম্ভবত পৌষ থেকে ছাপব। ভূপতি এখন পুরুলিয়ায়। পথিক ছাপা আরম্ভ হয়েছে, 1st formএর অর্ডার দিয়েছি। আমাদের চিঠি না পেলেও মাঝে মাঝে যেখানে হোক লিখো। শুভ ইচ্ছা জেনো। ইতি। গোকুলচন্দ্র নাগ।
নজরুলের বিষের বাঁশীর জন্যই পুলিশ হানা দিয়েছিল। মনে করেছিল সবাই এরা রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী। ভাবনৈতিক সন্ত্রাসবাদীদের দিকে তখনো চোখ পড়েনি। তখন আসেননি তারক সাধু।
কাগজে পড়েচো কলকাতায় ধরপাকড়ের ধুম লেগে গেছে। পবিত্র লিখল : কাজীর বিষের বাঁশী নিষিদ্ধ হয়েছে। কল্লোলের আপিস ও দোকান খানাতল্লাসী হয়েছে। সকলের মধ্যেই একটা প্রচণ্ড আশঙ্কাভীতি এসে গেছে। সি আই ডি-র উপদ্রবও সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কলকাতা শহরটাই তোলপাড় হয়ে গেছে। যেখানেই যাও চাপাগলায় এই আলোচনা। যারা ভুলেও কখনও রাজনীতির চিন্তা মনে আনে নাই তাদের মধ্যেও একটা সাড়া পড়ে গেছে–