মেজবৌদি গোকুলের জন্যে খাবার পাঠিয়ে দিলেন। কি করে খবর পেয়েছেন তিনি গোকুল আজ সারাদিন ধরে উপবাসী। বাড়িতে ফিরতে তার দেরি হয় বলে সে সাফাই নিয়েছে বাইরে খেয়ে-আসার। তার মানে, প্রায় দিনই একবেলা অভুক্ত থাকবার। কোনো-কোনদিন আরো নির্জন হবার অভিলাষে সে বলত, চলো, এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত হাঁটি, তার মানে তখন বুঝতে পারিনি পুরোপুরি। তার মানে, গোকুলের কাছে পুরোপুরি ড্রামভাড়া নেই।
অথচ এই গোকুল কোনো-কোনোদিন নৃপেনের পাশ ঘেঁসে বসে অলক্ষ্যে তার বুক-পকেটে টাকা ফেলে দিয়েছে যখন বুঝেছে নৃপেনের অভাব প্রায় অভাবনীয়।
অথচ যখন কথা বলতে যাও গোকুলের মুখে হাসি আর রসিকতা ছাড়া কিছু পাবে না। সুর করে যখন সে পূর্ববাংলার কবিতা বলত তখন অপরূপ শোনাত :
পদ্মা-পাইড়া রাইয়তগ লাঠি হাতে হাতে
গাঙের দিকে মুখ ফিরাইয়া ভাত মাখেন পাতে।
মাখা ভাতটি না ফুরাতেই ভাইঙ্গা পড়ে ঘর
সানকির ভাত কোছে ভইরা খোঁজেন আরেক চর।
টানদেশী গিরস্তগ বাপকালান্যা ঘটি
আটুজলে ডুব দেন আর বুকে ঠেকে মাটি।
আপনি পাও মেইল্যা বইস্যা উক্কায় মারেন টান,
একপহরের পথ ভাইঙ্গা বউ জল আনবার যান।
সাতাশ নম্বর কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে একটা একদুয়ারী এক চিলতে ঘরে কল্লোলের পাবলিশিং হাউস খোলা হয়। আপিস, থাকে সেই পটুয়াটোলা লেনেই। তার মানে সন্ধের দিকের তুমুল আড্ডাটা বাড়ির বৈঠকখানায় না হয়ে হাটের মাঝখানে দোকানঘরেই হওয়া ভালো। সেই চিলতে ঘরে সবাইর বসবার জায়গা হত না, ঘর ছাপিয়ে ফুটপাতে নেমে পড়ত। সেই ঘরকেই নজরুল বলেছিল একগাদা প্রাণভরা একমুঠো ঘর। সেই একমুঠো ঘরেই একদিন মোহিতলাল এসে আবির্ভূত হলেন। আমরা তখন এক দিকে যেমন যতীন সেনগুপ্তের পেসিমিজম-এ মশগুল, তেমনি মোহিতলালের ভাবঘন বলিষ্ঠতায় বিমোহিত। মোহিতলালকে আমরা মাথায় তুলে নিলাম। তিনি এসেই কবিতা আবৃত্তি করতে সুরু করলেন, আর সে কি উদাত্তনিস্বন মধুর আবৃত্তি! কবিতার গভীর রসে সমস্ত অনুভূতিকে নিষিক্ত করে এমন ভাবব্যঞ্জক আবৃত্তি শুনিনি বহুদিন। দেবেন সেনই আবৃত্তি করতে ভালোবাসতেন। আজো তাঁর সেই ভাবগদগদ কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি, দেখছি তার সেই অধমুদ্রিত চক্ষুর সূক্ষ্ম শুভ্ররেখা।
চাহি না আনার যেন অভিমানে ক্রুর
আরক্তিম গণ্ড ওষ্ঠ ব্রজসুন্দরীর,
চাহিনাক ‘সেউ’ যেন বিরহবিধুর
জানকীর চিরপা বদন রুচির।
একটুকু রসে ভরা চাহি না আঙুর
সলজ্জ চুম্বন যেন নববধূটির,
চাহিনা ‘গন্নার’ স্বাদ, কঠিনে মধুর
প্রগাঢ় আলাপ যেন প্রৌঢ় দম্পতির।
কল্লোল-পাবলিশিং হাউস থেকে প্রথম বই বেরোয় সুবোধ রায়ের নাটমন্দির—তিনটি একাঙ্ক নাটিকার সঙ্কলন। আর চতুষ্কলা ক্লাবে খানকয় পুরানো বই, ঝড়ের দোলা বা রূপরেখা—তার বিষয়বিভব। আর, সর্বোপরি, নজরুলের বিষের বাঁশী জমায় রেখে হুহু করে যে বেচতে পারছে এই তার ভবিষ্যতের ভরসা।
তেরোশ একত্রিশ সালের পূজার ছুটিতে কলকাতার বাইরে বেঁড়াতে যাই। সেখানে দীনেশদা আমাকে চিঠি লিখেন :
সোমবার
৩রা কার্তিক, ১৩৩১
সন্ধ্যা ৭-৩০ টা
পথের ভাই অচিন্ত্য,
কিছুদিন হল তোমার সুন্দর চিঠিখানি পেয়ে কৃতার্থ হয়েছি। তোমাকে ছাড়া আমাদেরও কষ্ট হচ্ছে—কিন্তু যখন ভাবি হয়ত ওখানে থেকে তোমার শরীর একটু ভাল হতে পারে তখন মনের অতখানি কষ্ট থাকে না।
হয়ত এরই মধ্যে পবিত্র ও ভূপতির বড় চিঠি পেয়েছ। কি লিখেছে তারা তা জানি না, তবে এটা শুনেছি যে পত্র দুখানাই খুব বড় করে লিখেছে।
আজ সারাদিন খুব গোলমালে গেল। এই কিছুক্ষণ আগে মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা আমার শেষ হল। শৈল, মুরলী, গোকুল, নৃপেন, পবিত্র ভূপতি প্রভৃতি কল্লোল আপিস ছেড়ে গেল। আমি স্নান সেরে এসে নিরালায় তাই তোমার কাছে এসেছি। এইটুকু আমার সময় কিন্তু তাও কেউ কেউ আসেন কিংবা মনের ভিতরই গোলমাল চলতে থাকে।
কাল রবিবার গেল, মুরলীদার বাড়ীতে সন্ধ্যাবেলা জোর আচ্ছা। বসেছিল। চা, পান, গান, মান, অভিমান সবই খুব হল। বীরেনবাবু ও জ্ঞানাঞ্জন পাল মহাশয়রাও ছিলেন।
রূপরেখার বেশ একটা রিভিয়ু বেরিয়েছে Forward-এ কালকের।
নাটমন্দিরও আজ বেরিয়ে গেল। এবার তোমাদের পালা। একখানা করে সবাইকার বের করতেই হবে। কেমন? অন্তত একশটি টাকা আমাকে প্রথম এনে দাও, আর তোমাদের লেখাগুলি, তা হলেই কাজ শুরু করে দিতে পারি।
প্রেমেন এসেছে ফিরে, তাকেও জোর দিয়েছি। সে তো একটু seriouslyই ভাবছে।
শৈলজার রাঙাশাড়ীখানা যদি পাওয়া যায়—যেতেও পারে—তা হলে তো কথাই নেই।
তোমার চাষা-কবি এখনও পেলাম না কেন? এতই কি কাজ যে কপি করে আজও পাঠাতে পারলে না? তোমার কবিতাটিই যে আগে যাবে, সুতরাং কবিতা পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত করবে। এবারে প্রেমেনের কমলা কেবিনটা ফিরিয়ে পেলে হয়তো যাবে। তুমি না থাকাতে তার যথেষ্ট একলা লাগছে বুঝতে পারি। সত্যি, বেচারার একটা আস্তানা নেই যে খাবে থাকবে।
কিন্তু এরকমই থাকব সব? না, তা হবে না-এই মাটি খুঁড়ে তা হলে শেষ চেষ্টা করে যাব। আমরা তো সইলাম আর বুঝলাম কিছু কিছু। কিন্তু যে কষ্ট নিজেরা পেলাম তা কি পরকে জেনে-শুনে দিতে পারি? ঐ সারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনাগত অযুত সংখ্যক কালকের মানুষের দল, তারা এসেও কি এই ভোগই ভুগবে? আমাদের এই সত্যের নির্বাক যুদ্ধ জয় করে রাখবে বাংলার প্রাণের প্রান্তে-প্রান্তে সবুজ পাতার বাসা। নীড়হারা পথহারা নীল-আকাশের রং-লাগান নীলপাখীর দল একেবারে সোজা সবুজ পাতার বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেবে। পথের বাঁকের বিরাট আয়ুবৃদ্ধ বটগাছ দেখবে বাংলার প্রান্ত হতে প্রান্তে রুক্ষরূপের বক্ষভেদ করে ফুটে আছে অপরাজিতার দল।