জীবনের চরম সার্থকতা এই প্রেমের জাগরণে। যতদিন না এই প্রেম জাগে ততদিন মানুষ খণ্ডিত থাকে, সে নিজেকে পায় না সম্পূর্ণ করে। কিন্তু বন্ধুর মাঝে যেই সে আপনাকে প্রসারিত করে দিতে পারে তখনই সে-খণ্ডতার হীনতা দুঃখ ও লজ্জা থেকে মুক্তি পেয়ে সার্থক হয়। আমি যতদিন বন্ধুকে অন্তর দিয়ে ভালবাসতে না পারি ততদিন আমার দরজা বন্ধ থাকে। যে পথে আনন্দময় পৃথিবীর চলাচল সে-পথ আমি পাই না।
কথাটাকে কিছুতেই গুছিয়ে ভাল করে বলতে পারছি না, শুধু অন্তরে অনুভব করছি এর সত্য। এইটুকু বুঝতে পারছি প্রিয়া আমার জীবনের যতখানি, বন্ধু তার চেয়ে কম নয়। এই কমরেডশিপের মুল্য হুইটম্যান প্রথম বোঝাতে চেষ্টা করেন। আমরাও একটু বুঝেছি মনে হয়। এখানে হুইটম্যান থাকলে সেই জায়গাটা একটু তুলে দিতুম।
বন্ধুত্ব, কমরেডশিপ ইত্যাদি কথাগুলো সব জাতির ভাষাতেই বহুকাল ধরে চলে আসছে, কিন্তু এই বন্ধুত্ব কথাটার ভেতরকার অর্থের গভীরতা দিন দিন মানুষ নতুন করে উপলব্ধি করছে। পঞ্চাশ বছর আগে এ কথাটার মানে যা ছিল আজ তা নেই, আকাশের মত এ কথাটার অর্থের আর সীমা, বিস্ময়ের আর পার নেই।
আমার অন্তরের দেবতা তোর অন্তরের দেবতার মিলন-প্রয়াসী, তাই তো তুই আমার বন্ধু। আমরা নিজেদের অন্তরের দেবতাকে চিনি না ভাল করে, ক্রমাগত চেনবার চেষ্টা করছি মাত্র। বন্ধুর ভেতর দিয়েই তাকে ভালো করে চিনি।
শুধু প্রিয়াকে পেল না বলে যে কাঁদে, সে হয় মূর্খ, নয় যৌনপিপাসার স্তরে আবদ্ধ অন্ধ। প্রিয়ার মাঝেও যতক্ষণ না এই বন্ধুকে খুঁজি ততক্ষণ প্রিয়াকে পূর্ণ করে পাই না। যে প্রেম বৃহৎ সে প্রেম মহৎ। সে প্রেম প্রিয়ার মাঝে এই বন্ধুকে খোঁজে বলেই বৃহৎ ও মহৎ। প্রিয়ার মাঝে শুধু নারীকে খুঁজত ও খোঁজে পশু।
অনেকক্ষণ বললুম। তোর ভাল লাগবে কি এই একঘেয়ে বক্তৃতা? তবু না বলে পারি না, কারণ তুই যে আমার বন্ধু।
দিন-দিন নিজের অজ্ঞাতে একটা বিশ্বাস বাড়ছে যে মৃত্যুই চরম কথা নয়। কিরণ* অর্থহীন জীবন বুদ্বদ ছিলনা–আরো কিছু–কি?
চিঠি দিস, ওখানকার সব খবর লিখিস। খুব লম্বা চিঠি দিবি। আভ্যুদয়িকের খবর, কল্লোল আফিসের খবর, শৈলজা, মুরলীদা, শিশির, বিনয়ের খবর ইত্যাদি ইত্যাদি সব চাই। পড়াশুনা করছি না মোটে। কি লিখছিস আজকাল? সেদিন যিনি ফল খেতে দিলেন তিনিই কি তোর মা? তোর মাকে আমার প্রণাম দি।–তোর প্রেমেন্দ্র মিত্র
————
[*কিরণ দাশগুপ্ত। আমার বন্ধু। আত্মহত্যা করে।]
০৭. কাজীর বিষের বাঁশী নিষিদ্ধ
ঘোর বর্ষায় পথ-ঘাট ডুবে গেলেও আড্ডা জমাতে আসতে হবে তোমাকে কল্লোল: আপিসে—তা তুমি ভবানীপুরেই থাকো বা বেলেঘাটায়ই থাকে। আর সোমনাথ আসত সেই কুমোরটুলি থেকে। সোমনাথের যেটা বাড়ি তার নিচেটা চালের আড়ত, সারবাঁধা চালের বস্তায় ভর্তি। উপরে উঠে গিয়ে চালের গাদি পেরিয়ে সোমনাথের ঘর। একটা জলজ্যান্ত প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদ শুধু তার ঘরে নয়, চেহারায়ও। গদির মালিকদের পরনে আটহাতি ধুতি, গা খালি, গলায় তুলসীর কন্ঠী। সোমনাথের পরনে ঢিলেঢালা অঢেল পাঞ্জাবি, লম্বা ললাটানো কোচা, অতৈললাঞ্ছিত চুল ফঁাপিয়োপিয়ে ব্যাকব্রাশ করা। সব মিলিয়ে একটা উদ্ধত বিদ্রোহ সন্দেহ নেই, কিন্তু দেখতে যেমন সৌম্যদর্শন, শুনতেও তেমনি অতিন। মোলায়েম মিষ্টি হেসে একটু বা চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে, কথায় পরিহাসের রসটাই বেশি। অথচ এদিকে খুব বেশি সিরিয়স—পড়ছে মেডিকেল কলেজে। ডাক্তারি করবে অথচ গল্প লিখছে ভারতীতে, কাগজ বের করেছে ঝর্ণা বলে। (একটা স্মরণীয় ঘটনার জন্যে ও কাগজের নাম থাকবে, কেননা ও কাগজেই সত্যেন দত্তের ঝর্ণা কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল।) এ হেন সোমনাথ, হঠাৎ শোনা গেল, ব্রাহ্ম হচ্ছে। সখের ব্রাহ্ম নয়, কেতাদুরস্ত ব্রাহ্ম। গোকুলই খবর নিয়ে এল তার দীক্ষার দিন কবে। স্থান ভবানীপুর সম্মিলন সমাজ। গেলাম সবাই মজা দেখতে। গিয়ে দেখি গলায় মোটা ফুলের মালা পরে সোমনাথ ভাবে গগদ হয়ে বসে আছে আর আচার্য সতীশ চক্রবর্তী ফুল দিয়ে সাজানো বেদী থেকে হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা দিয়ে তাকে দীক্ষিত করছেন। বহু চেষ্টা করে চোখের সঙ্গে চোখ মিলিয়ে তাকে টলানো গেল না, ধর্মবিশ্বাসে সে এত অবিচল। ব্যাপার কি? মনোবনবিহারিণী কোনো হরিণী আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু, কি পরিহাস, কিছুকাল পরে বিধিমত হিন্দুমতে সমাজমনোনীত একটি পাত্রীর পাণিগ্রহণ করে বসল। সোমনাথ সাহা কল্লোল যুগের এক ঝলক বাসন্তী হাওয়া।
সমস্ত বিকেলে হৈ-চৈ-হল্লার পর সন্ধ্যোত্তীর্ণ অন্ধকারে গোকুলের সঙ্গে একান্ত হবার চেষ্টা করতাম। কল্লোল-অপিসে একখানি যে চটের ইজিচেয়ার ছিল তা নিয়ে সারাদিন কাড়াকাড়ি গেছে—এখন, নিভৃতে তাইতেই গা এলিয়েছে গোকুল। পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে বুঝি? সারাদিন সুবোধকে পথিকের তলিপি দিয়েছে। তারই জন্যে কি এই ক্লান্তি? মনে হত, শুধু শারীরিক অর্থেই যেন এ ক্লান্তির ব্যাখ্যা হবে না। যেন আত্মার কোন গভীর নিঃসঙ্গতা একটি মহান অচরিতার্থতার ছায়া মেলেছে চারপাশে; হয়তো অন্ধকার আর একটু ঘন ও অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলেই তার আত্মার সেই গভীর স্বগতোক্তি শুনতে পাব।
কিন্তু নিজের কথা এতটুকুও বলতে চাইত না গোকুল। বলতে ভালোবাসত ছেলেবেলাকার কথা। সতীপ্রসাদ সেন—আমাদের গোরাবাবু–গোকুলের সতীর্থ, নিত্যি যাওয়া-আসা ছিল তার বাড়িতে, রূপনারায়ণ নন্দন লেনে। গোরাবাবুদের বাড়ির সামনের শীতলাতলায় বৈশাখ মাসে তিন দিন ধরে যাত্রা হত, শলমা-চুমকির পোশাক-পরা রাজা-রানিসখির দল সরগরম করে রাখত সেই শীতলাতলা। প্রতি বৎসর গোরাবাবুদের বাড়ির ছাদে বসে সারারাত যাত্রা শুনত গোকুল—একবার কেমন বেহালা নিয়ে এসেছিল সখীদের গানগুলো বেহালায় তুলে নেবার জন্যে। কি বলতে চাইত আর আগের কথা। সেই যখন সাউথ সুবার্বান স্কুলে ফিফথ ক্লাশে এসে ভর্তি হল। অত্যন্ত লাজুক মুখচোরা ছেলে, ক্লাশের লাস্ট বেঞ্চিতে লুকিয়ে থাকবার চেষ্টা। আলিপুরে মামার বাড়িতে থাকে, মামা ব্রাক্ষ, তাই তার কথাবার্তায় চালচলনে একটা চকচকে গোছগাছ ভাব সকলের নজরে না পড়ে যেত না। তার উপর মার্বেল ডাণ্ডাগুলি চু-কপাটি খেলবে না কোনোদিন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে, আর নাকি খাতার পাতায় ছবি আঁকে, কবিতা লেখে। রাষ্ট্র হয়ে গেল, ও বেহ্মজ্ঞানী। সে নাজানি কি রকম জীব, ছেলেরা মন খুলে মিশত না, কপট কৌতূহলে উঁকিঝুকি মারত। মাস্টার-পণ্ডিতরাও টিটকিরি দিতে ছাড়তেন না। ফোর্থ ক্লাশে যখন পড়ে তখন ওর খাতায় কবিতা আবিষ্কার করে ওর পাশের এক ছাত্র পণ্ডিতমশায়ের হাতে চালান করে দেয়। পড়ে পণ্ডিতমশায় সরাসরি চটে উঠতে পারলেন না, ছন্দেবন্ধে কবিতাটি হয়ত নিখুত ছিল। শুধু নাক সিঁটকে মুখ কুঁচকে বলে উঠলেন : এতে যে তোদের রবিঠাকুরের ছায়া পড়েছে! কেন, মাইকেল হেম নবীন পড়তে পারিস না? রবিঠাকুর হল কিনা কবি। তার আবার কবিতা। আহা, লেখার কি নমুনা। রাজার ছেলে যেত পাঠশালায়, রাজার মেয়ে যেত তথা— তথা—কথাটা এমন মুখভঙ্গি করে ও হাত নেড়ে উচ্চারণ করলেন যে ক্লাশশুদ্ধ, ছেলেরা হেসে উঠল।