ঐ পোস্টকার্ডটিই গোকুল।
ঐ পোস্টকার্ডটিই সমস্ত কল্লোলের সুর। কল্লোলেরর স্পর্শ। তার নীড়নির্মাণের মূলমন্ত্র।
খবর শুনে মন নরম হয়ে গেল। আমার লেখা বাতিল হলেও আমার মূল্য নিঃশেষ হয়ে গেল না এত বড় সাহসের কথা কোনো সম্পাদকই এর আগে বলে পাঠায়নি। যা লিখেছি তার চেয়ে যা লিখব তার সম্ভাব্যতারই যে দাম বেশি এই আশ্বাসের ইসারা সেদিন প্রথম পেলাম সেই গোকুলের চিঠিতে।
সুবোধ বললে, তোমার খাতা বের করো।
তখন আমি আর আমার বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্র মোটা-মোটা বাঁধানো খাতায় গল্প-কবিতা লিখি। লিখি ফাউন্টেন পেনে নয়—হায়, ফাউন্টেন পেন কেনবার মত আমাদের তখন পয়সা কোথায়-লিখি বাংলা কলমে, সরু জি-মার্কা নিবে। অক্ষর কত ছোট করা যায় চলে তার অলক্ষ্য প্রতিযোগিতা। লেখার মাথায় ও নিচে চলে নানারকম ছবির কেরামতি।
তারিখটা আমার ডায়রিতে লেখা আছে—৮ই জ্যৈষ্ঠ, বৃহস্পতিবার, ১৩৩১ সাল। সন্ধেবেলা সুবোধের সঙ্গে চললাম নিউ মার্কেটের দিকে। সেখানে কি? সেখানে গোকুল নাগের ফুলের দোকান আছে।
যে দোকান দিয়ে বসেছে সে ব্যবসা করতে বসেনি এমন কথা কে বিশ্বাস করতে পারত? কিন্তু সেদিন একান্তে তার কাছে এসে স্পষ্ট অনুভব করলাম, চারপাশের এই রাশীভূত ফুলের মাঝখানে তার হৃদয়ও একটি ফুল, আর সেই ফুলটি ও সে অকাতরে বিনামূল্যে যে-কারুর হাতে দিয়ে দিতে প্রস্তুত।
সুবোধের হাত থেকে আমার খাতাটা সে ব্যগ্র উৎসাহে কেড়ে নিল। একটিও পৃষ্ঠা না উলটিয়ে কাগজে মুড়ে রেখে দিলে সন্তর্পণে। যেন নীরব নিভৃতিতে অনেক যত্নসহকারে লেখাগুলো পড়তে হবে এমনি ভাব। হাটের মাঝে পড়বার জিনিস তারা নয়—অনেক সদ্ব্যবহার ও অনেক সদ্বিবেচনা পাবার তারা যোগ্য। লেখক নতুন হোক, তবু সে মর্যাদার অধিকারী।
এমনি ছোটখাটো ঘটনায় বোঝা যায় চরিত্রের বিশালতা।
বুঝলাম কত বড় শিল্পীমন গোকুলের। অনুসন্ধিৎসু চোখে আবিষ্কারের সম্ভাবনা দেখছে। চোখে সেই যে সন্ধানের আলো তাতে তেল জোগাচ্ছে স্নেহ।
যখন চলে আসি, আমাকে একটা ব্লকপ্রিন্স উপহার দিলে। বললে, কাল সকালে আপনি আর সুবোধ আমার বাড়ি যাবেন, চা খাবেন।
আপনার বাড়ি–
আমার বাড়ি চেনেন না? আমার বাড়ি কোথায় চেহারা দেখে ঠাহর করতে পারেন না?
কি করে বলব?
কি করে বলবেন। আমার বাড়ি জু-তে, চিড়িয়াখানায়। আমার বাড়ি মানে মামার বাড়ি। কোনো ভয় নেই। যাবেন স্বচ্ছন্দে।
পরদিন খুব সকালে সুবোধকে নিয়ে গেলাম চিড়িয়াখানায়। দেখলাম শিশিরভেজা গাঢ়-সবুজ ঘাসের উপর গোকুল হাটছে খালি পায়ে। বোধহয় আমাদেরই প্রতীক্ষা করছিল। তার সেদিনের সেই বিশেষ চেহারাটি বিশেষ একটা অর্থ নিয়ে আজো আমার মনের মধ্যে বিধে আছে। যেন কিসের স্বপ্ন দেখছে সে, তার জন্যে সংগ্রাম করছে প্রাণপণ, প্রতীক্ষা করছে পিপাসিতের মত। অথচ, সংগ্রামের মধ্যে থেকেও সে নির্লিপ্ত, নিরাকাঙ্ক্ষ। জনতার মধ্যে থেকেও সে নিঃসঙ্গ, অনন্যসহায়।
তার ঘরে নিয়ে গেল আমাদের। চা খেলাম। সিগারেট খেলাম। নিজের অজানতেই তার অন্তরের অঙ্গ হয়ে উঠলাম। বললে, আপনার গুমোট গল্পটি ভালো লেগেছে। ওটি ছাপব আষাঢ়ে।
কল্লোলের তখন দ্বিতীয় বর্ষ। প্রথম প্রকাশ বৈশাখ, ১৩৩০। সম্পাদক শ্রীদীনেশরঞ্জন দাশ; সহ-সম্পাদক, শ্রীগোকুলচন্দ্র নাগ। প্রতি সংখ্যা চার আনা। আট পৃষ্ঠা ডিমাই সাইজে ছাপা, প্রায় বারো ফর্মার কাছাকাছি।
নিজের সম্বন্ধে কথা বলতে এত অনিচ্ছুক ছিল গোকুল। পরের কথা জিজ্ঞাসা করো, প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। তবু যেটুকু খবর জানলাম মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
গোকুল হালে সাহিত্য করছে বটে, কিন্তু আসলে সে চিত্রকর। আর্ট স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়েছে সে। অয়েল পেন্টিংএ তার পাকা হাত। তারপর তার লম্বা চুল দেখে যে সন্দেহ করেছিলাম, সে সত্যিই-সত্যিই বেহালা বাজায়। আর, আরো আশ্চর্য, গান গায়। শুধু তাই? সোল অফ এ শ্লেভ বা বাদীর প্রাণ ফিমে সে অভিনয়ও করেছে অহীন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে। শিল্প-পরিচালকও ছিল সে-ই।
গোকুল ও তার বন্ধুদের ফোর আর্টস ক্লাব নামে একটা প্রতিষ্ঠান ছিল। বন্ধুদের মধ্যে ছিল দীনেশরঞ্জন দাশ, মণীন্দ্রলাল বসু আর সুনীতি দেবী। এরা চার জনে মিলে একটা গল্পের বইও বের করেছিল, নাম ঝড়ের দোলা। প্রত্যেকের একটি করে গল্প। মাসিক পত্রিকা বের করারও পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু তার আগে ক্লাব উঠে গেল।
আমার ব্যাগে দেড় টাকা আর দীনেশের ব্যাগে টাকা দুইঠিক করলাম কল্লোল বের করব। স্নিগ্ধ উত্তেজনায় উজ্জ্বল দুই চোখ মেলে গোকুল তাকিয়ে রইল বাইরের রোদের দিকে। বললে, সেই টাকায় কাগজ কিনে হাবিল ছাপালাম। চৈত্র সংক্রান্তির দিন রাস্তায় বেজায় ভিড়, জেলেপাড়ার সং দেখতে বেরিয়েছে। সেই ভিড়ের মধ্যে দুজনে আমরা হাবিল বিলোতে লাগলাম। পরমুহূর্তেই আবার তার শান্ত স্বরে ঔদাস্যের ছোঁয়া লাগল। বললে, তবু ফোর আর্টস্ ক্লাবটা উঠে গেল, মনে কষ্ট হয়।
বললাম, আপনিই তো একাধারে ফোর আর্টস। চিত্র, সঙ্গীত, সাহিত্য, অভিনয়।
নম্রতায় বিমর্ষ হয়ে হাসল গোকুল। বললে, আসুন আপনারা সবাই কল্লোলে। কল্লোলকে আমরা বড় করি। দীনেশ এখন দার্জিলিঙে। সে ফিরে আসুক। আমাদের স্বপ্নের সঙ্গে মিশুক আমাদের কর্মের সাধনা।
যখন চলে আসি, গোকুল হাত বাড়িয়ে আমার হাত স্পর্শ করল। সে স্পর্শে মামুলি শিষ্টাচার নয়, তার অনেক বেশি। একটি উত্তপ্ত স্নেহ, হয়তো বা অস্ফুট আশীর্বাদ।