কমলা বলল—কিন্তু রবিবাবুকে আমি ওটা বুকের আঁচল–
মিসেস ডি বলিল—তর্ক কোর না, যা বলছি শোন। আর কমলাটারও আচ্ছা বুদ্ধি! না হয় রবিবাবু গেয়েছিলেন বুকের আঁচল–কিন্তু এদিকে বুকের আঁচলটা ধূলায় পাততে গেলে যে ব্যাপারটা হবে তার সম্বন্ধে কবির অনভিজ্ঞতাকে কি প্রশ্রয় দেওয়া উচিত?…
বীরেন্দ্রনাথ বলিলেন—আজকের ব্যাপারের হোষ্টেস কে?
দীপ্তি। দিদি।
মায়া ফোঁস করিয়া উঠিল—হাঁ, তা-ত হবেই, ছাই ফেলতে এমন ভাঙা কুলো আর কে আছে বল?
করুণা বলিলেন-ঝগড়াঝাঁটির দরকার কি? মেমেদের মত তোদের ত আর সঙ্গে নিয়ে এক টেবিলে খেতে হবে না-তোরা খাওয়াবি।
মায়া বলিল—তাও ত বটে।
সুবর্ণ। টেবিলে! তার মানে? ওরা কি কখনো টেবিলে খেয়েছে? একটা বিদঘুটে কাণ্ড না করে তোমরা ছাড়বে না দেখছি। চিবোনো জিনিষগুলো চারদিকে ছড়িয়ে ফেলবে-মুখে ভাত তোলার সময় সর-সর শব্দের সঙ্গে ঝর-ঝর করবে। হাতটা চাটতে চাটতে কনুই পর্যন্ত গিয়ে ঠেকবে–
মায়া হাসিয়া বলিল, আচ্ছা মা, তুমি কি কোনদিন ওঁদের খেতে দেখেছ?
সুবর্ণ। দেখব আবার কি। মেসে থাকে, এক সঙ্গে পঞ্চাশজনে মিলে বাইরের কলে চান করে আর চেঁচামেচি কাড়াকাড়ি করে খায়— আমাদের কর্পূরীটোলা লেনের বাড়ীর ছাদ থেকে একটা মেস স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়, ছেলেগুলো শুধু-গায়ে বিছানার ওপর শুয়ে শুয়ে পড়ে, আর পড়ে তো কত! খাটের ছৎরিতে ময়লা গামছা আর ঘরের কোণে গামলায় পানের পিক, এ থাকবেই।
কল্যাণী বলিল,–মুনিবাবু, আপনি আমার খুব কাছে কাছে থাকুন না–
মুনি কিছু বুঝিতে না পারিয়া কল্যাণীর মুখের দিকে চাহিল।
কল্যাণী হাসিয়া বলিল—জানেন না বুঝি, এটা ব্রাহ্মপাড়া। চারপাশের জানালাগুলোর দিকে একটু ভাল করে চেয়ে দেখুন, দেখবেন, কত ছোটবড় কত রকমের সব চোখ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আধঘণ্টার মধ্যেই গেজেট ছাপা হয়ে যাবে। ঐ যে প্রকাশ হলদে রং-এর বাড়ীটা দেখছেন ওটা হচ্ছে মিসেস ডির বাড়ী, ওঁকে চেনেন না?
মুনি ভীতভাবে বলিল—চলুন নীচে যাই, দরকার নেই ওসব গণ্ডগোলে।
কল্যাণী হাসিয়া বলিল—এই আপনার সাহস?
মুনি বলিল–তলোয়ারের চেয়ে জিভটাকে আমি ভয় করি। চলুন—
কল্যাণী বলিল—Its too late. ঐ দেখুন–
মুনি দেখিল প্রায় প্রত্যেক জানালা হইতে মেয়েরা বিশেষ আগ্রহের সহিত দেখিতেছে।
মিস লতিকা চ্যাটার্জি তাহার মাতাকে বলিল—মা, আমি এই গোল্ড-গ্রে শাড়ীটার সঙ্গে বাফ ব্লাউজটা পরব?
মিসেস চ্যাটার্জি। ওটা না তুই মিসেস গুপ্তর পার্টিতে পরে গিয়েছিলি!
লতিকা। তবে এই ফ্লেম কলারের শাড়ী আর স্যামন পিঙ্ক ব্লাউজটা পরি, কি বল মা?
মিসেস চ্যাটার্জি। মরি মরি, যে না রূপের মেয়ে, ঠিক যেন কয়লার বস্তায় আগুন লেগেছে মনে হবে।
তাহার পর মাতা এবং কন্যার মধ্যে যে প্রহসন সুরু হইল তাহার দর্শক কেহ থাকিলে দেখিত, কাপড় জামা ঘরময় ছড়াইয়া লতিকা তাহার উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া হিষ্টিরিয়া-গ্রস্ত রোগীর ন্যায় হাত-পা ছুঁড়িতেছে এবং তাহার মাথার কাছে বলিয়া মিসেস চ্যাটার্জি তাহাকে কিলাইতেছেন।
নজরুলের যেমন ছিল দে গরুর গা ধুইয়ে, গোকুলের তেমনি ছিল, কালী কুল দাও মা, নুন দিয়ে খাই। এমনিতে ক্লান্ত-কঠিন গম্ভীর চেহারা, কিন্তু শুকনো বানি একটু খুঁড়তে পেলেই মিলে যাবে শীতল স্নিগ্ধ জলস্পর্শ। দীনেশ আর গোকুল দুজনেই সংসারসংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত, দুজনেই অবিবাহিত-দুজনের মাঝেই দেখেছি এই স্নেহের জন্যে শিশুর মত কাতরতা। স্নেহ যে কত প্রবল, স্নেহ যে কত পবিত্র, স্নেহ যে মানুষের কত বড় আশ্রয় তা দুজনেই তাঁরা বেশি করে বুঝতেন বলে তাঁরা দুজনেই স্নেহে এত অফুরন্ত ছিলেন।
প্রেমেন ঢাকায় ফিরে যাবে, আমি আর শৈলজা তাকে শেয়ালদা স্টেশনে গিয়ে তুলে দিলাম। প্রেমেন লিখলে ঢাকা থেকে :
অচিন,
এই মাত্র কল্লোল অফিস থেকে সংক্রান্তির ফাইলের সঙ্গে তোর, শৈলজার আর দীনেশবাবুর চিঠি পেলুম।
সারাদিন মনটা খারাপই ছিল। খারাপ থাকবারই কথা। কলেজে যাই না, এখানেও জীবনটা অপব্যয় করছি। কিন্তু তোদর চিঠি পেয়ে এমন আনন্দ হল কি বলব।
ভাই, একটা কথা তোকে আগেও একবার বলেছি, আজও একবার বলব—না বলে পারছি না। দ্যাখ ভাই, জীবনে অনেক কিছুই পাইনি, কিন্তু যা পেয়েছি তার জন্যে একবার কৃতজ্ঞ হয়েছি কি? এই বন্ধুদের ভালবাসা—এর দাম কি কোন ভালবাসার চেয়ে কম? এর দাম আমরা সব চুকিয়ে কি দিতে পেরেছি?
আদিম মানুষ অর্ধসভ্য, মানুষ ছিল একক, হিংস্র। সে আরেকটা পুরুষকে কাছে ঘেঁষতেও দিত না। (উর্দ্ধতনের গোড়ার দিকের কথা বলছি) নারীর প্রতিও তার কাম তখনও প্রেমে রূপান্তরিত হয়নি। তারপর অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবু হুইটম্যান যখন sexless loveএর কথা প্রথম প্রচার করেছিলেন অনেকেই মনে-মনে হেসেছিল, এখনও অনেকে হয়ত হাসে। কিন্তু আমি জানি ভাই, মানুষ পশুত্বের সে-স্তর ছাড়িয়ে এখন যে-স্তরে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে সেখানে যৌনসম্বন্ধ ছাড়াও আর একটা সম্বন্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের হওয়া সম্ভব। কথা ভাল করে হয়ত বোঝাতে পারলুম না। তবুও তুই বুঝতে পারবি জানি।
এই যে প্রেম, মানুষের অন্তরের এই যে নতুন এক প্রকাশ এটা এত দিন সম্ভব ছিল না। যৌনমিলনপিপাসা ও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে দরকারী ক্ষুধা ও প্রবৃত্তিকে নিবৃত্ত করতেই একদিন মানুষের। দিন কেটে যেত। নিজের অন্তরের গভীরতর সত্যকে তলিয়ে খুঁজে বুঝে দেখবার অবসর তার ছিল না। আজ কয়েকজনের হয়েছে বা কয়েকজন সে অবসর করে নিয়েছে।