মোরা ভাই বাউল চারণ মানি না শাসন বারণ
জীবন মরণ মোদের অনুচর রে।
দেখে ঐ ভয়ের ফাঁসি হাসি জোর জয়ের হাসি
অবিনাশী নাইক মোদের ডর রে।
যা আছে যাক না চুলায়, নেমে পড় পথের ধূলায়
নিশান দুলায় ঐ প্রলয়ের ঝড় রে।
ধর হাত ওঠরে আবার দুর্যোগের রাত্রি কাবার
ঐ হাসে মার মূর্তি মনোহর রে।
জীবনে এমন কয়েকটা দিন আসে যা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে স্মৃতিতে—অক্ষরও মুছে যায় ক্রমে-ক্রমে কিন্তু সেই স্বর্ণচ্ছটা জেগে থাকে আমরণ। তেমনি সোনার আলোয় আলো করা দিন এ। রেখা মুছে গেছে কিন্তু রূপটি আছে অবিনশ্বর হয়ে। দুপুরে গঙ্গায় স্নান, বিকালে গঙ্গায় নৌকাভ্রমণ, রাত্রে আহার-এ একটা অমৃতময় অভিজ্ঞতা। বায়ু জল তরু লতা তারা আকাশ সব মধুমান হয়ে উঠেছে। মৃত্যুজিৎ যৌবনের আস্বাদনে। সৃষ্টির উল্লাসে বলীয়ান হয়ে উঠেছে। দুর্বার কল্পনা।
সেই রাত্রে আর গান নেই, সুরু হল কবিতা। প্রেমেন একটা কবিতা আবৃত্তি করলে-বোধ হয়, কবি নাস্তিক। বুক দিলে যে, ভুখ দিলে যে, দুখ দিতে সে ভুলল না, মৃত্যু দিলে লেলিয়ে পিছে পিছে। আমিও অনুসরণ করলাম। দে গরুর গা ধুইয়ে। এরা আবার কবিতাও লেখে নাকি? সবাই অভিনন্দন করে উঠল এই প্রথম ও অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারে। বলো, আরো বলো—আরও যটা মুখস্ত আছে।
ফিরতি ট্রেন কখন চলে গিয়েছে। নেমে এসেছে ক্লান্তিহরণ স্তব্ধতা। কিন্তু নৃপেন কাউকে ঘুমুতে দেবে না। যেন একটা ঘরছাড়া অনিয়মের জগতে চলে এসেছি সবাই। দেখলাম, বাড়ি ফিরে না গেলেও চলে, দিব্যি না ঘুমিয়ে আড্ডা দেওয়া যায় সারারাত। প্রতিবেশী হৃদয়ের উত্তাপের পরিমণ্ডলে এসে নবীন সৃষ্টির প্রেরণা লাভ করা যায়, কেননা আমরা জেনে নিয়েছি, আমরা সব এক প্রাণে প্রেরিত। এক ভবিষ্যতের দিশারী।
বিষের বাঁশীর ভূমিকায় নজরুল দীনেশরঞ্জনকে উল্লেখ করেছিল আমার ঝড়ের রাতের বন্ধু বলে। দীনেশরঞ্জন বয়সে আমাদের সকলের চেয়ে বড়, কিন্তু আশ্চর্য, বন্ধুতায় প্রত্যেকের সমবয়সী, একেবারে নিভৃততম, দুঃসহতম মুহূর্তের লোক। কি আকর্ষণ ছিল তাঁর, তার কাছে প্রত্যেকের নিঃসঙ্কোচ ও নিঃসংশয় হবার ব্যাকুলতা জাগত। অথচ এত ঘনিষ্ঠতার মাঝেও একদিনের জন্যেও তাঁর জ্যেষ্ঠত্বের সন্ত্রম হারাননি। তাঁর দৃঢ়তাকে উচ্চতাকে অবনমিত করেননি। নিজে আর্টিস্ট ছিলেন, তাই একটি পরিচ্ছন্ন শালীনতা তার চরিত্রে ও ব্যবহারে মিশে ছিল। তারই জন্যে এত আস্থা হত তার উপর। মনে হত, নিজে নিঃসম্বল হলেও নিঃসম্বলদের ঠিক তিনি নিয়ে যাবেন পরিপূর্ণতার দেশে। নিজে নিঃসহায় হলেও নিঃসহায়দের উত্তীর্ণ করে দেবেন তিনি বিপদ-বাধার শেষে শ্যামলিম সমতলতায়।
দীনেশরঞ্জনের বিদ্রোহ রাজনৈতিক নয়, জীবনবাদের বিদ্রোহ। একটা আদর্শকে সমাজে-সংসারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে বৈরাগ্যভূষণ সংগ্রাম। সাংসারিক অর্থে সাফল্য খোঁজেন নি, শুধু একটি ভাবকে সব কিছুর বিনিময়ে ফলবান করতে চেয়েছিলেন। সে হচ্ছে সত্য ভাষণের আলো-কে সাহিত্যের পৃষ্ঠায় অনির্বাণ করে রাখা। প্রতিদিনকার সাংসারিক তুচ্ছতার ক্ষেত্রে অযোগ্য এই দীনেশরঞ্জন কত বিদ্রুপ-লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন জীবনে, কিন্তু আদর্শভ্রষ্ট হননি। তাঁর দীপায়নের উৎসবে ডাক দিয়ে আনলেন যত হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথার ঘরছাড়াদের। বললেন, অমৃতের পুত্রকে কে বলে গৃহহীন? এই ঘরছাড়াদের নিয়েই ঘর বাঁধব আমি। থাকব সবাই মিলে একটা ব্যারাক বাড়িতে। কেউ বিয়ে করব না। বিভক্ত হব না। থাকব অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতায়। সাহিত্যের ব্রতে একনিষ্ঠ হব। মৃত্যুর পরে কোনো সহজ সুন্দর পরলোক চাই না, এই জীবনকেই নব-নব সৃষ্টির ব্যনায় অর্থ দেব, মূল্য দেব নব-নব পরীক্ষায়।
কিন্তু গোকুলের বিদ্রোহ সাহিত্যিক বিদ্রোহ। গোকুলকে থাকতে হত তার ব্রাহ্ম মামাবাড়িতে নানারকম বিধি-বিধানের বেঁড়াজালে। সে বাড়িতে গোকুলকে গলা ছেড়ে কেউ ডাকতে পেত না বাইরে থেকে, কোনো মুহূর্তে জামা খুলে খালি-গা হতে পারত না গোকুল। এমন যেখানে কড়া শাসন, সেখান থেকে আর্টস্কুলে গিয়ে ভর্তি হল। তার অভিভাবকদের ধারণা, আর্টস্কুলে যায় যত বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানো ছেলে, এবার আর কি, রাস্তায়-রাস্তায় বিড়ি ফুঁকে বেঁড়াও গে। শুধু আর্ট স্কুল নয়, সেই বাড়ি থেকেই সিনেমায় যোগ দিলে গোকুল। সোল অফ এ শ্লেভ ছবিতে নামল একটি বিদূষকের পার্টে। সহজেই বুঝতে পারা যায় কত বড় সংঘর্ষ করতে হয়েছিল তার সেদিনকার সেই পরিপার্শ্বের সঙ্গে। নীতি-রীতির কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে। কিছু কিছু তার ছায়া পড়েছে পথিকে:
মায়া উঠিয়া মুখ ধুইয়া আসিয়া চুল আঁচড়াইতে আঁচড়াইতে গান ধরিল–
তোমার আনন্দ ঐ এলো দ্বারে
এলো–এলো–এলো গো!
বুকের আঁচলখানি I beg your pardon, miss–
সুখের আঁচলখানি ধূলায় পেতে
আঙ্গিনাতে মেল গো—
নাঃ আমার মুখটা দেখছি সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। ভাগ্যিস কেউ ছিল না-বুকের আঁচল বলে ফেলেছিলাম!
দীপ্তি হাসিয়া বলিল—বাবা! দিদি, তোকে পিরবার যো নেই!
মায়া। কেন, দোষটা শুধরে নিলাম তাতেও অপরাধ?
দীপ্তি। ওর নাম দোষ শুধরে নেওয়া? ও ত চিমটি কাটা।
মায়া। তা হলে আমার দ্বারা হয়ে উঠল না সভ্য হওয়া। তোদের মত ভাল মেয়ের পাশে থেকে যে একটু-আধটু দেখে শুনেও শিখব, তাও দিবি না? আচ্ছা সবাই এত রেগে যায় কেন বলতে পারিস? সেদিন যখন কমলা ঐ গানটা গাইছিল, মিসেস ডি এমন করে তার দিকে তাকালেন যে বেচারীর বুকের আঁচল বুকেই রইল, তাকে আর ধূলায় মেলতে হল না। মিসেস ডি বলে দিলেন, বই-এ ওটা ছাপার ভুল কমল, সুখের আঁচল হবে–