এই ফুলের স্টলে ঢুকেই গোকুলের কাছাকাছি এসে পড়েন। লক্ষ্য করেন একটি উদাসীন বিমনা যুবক ছিন্নবৃন্ত ফুল গুচ্ছের দিকে করুণ চোখে চেয়ে কি ভাবছে। হয়তো ভাবছে ফুল বেচে জীবিকার্জন করতে হবে এ কি পরিহাস! পরিহাসটা আরো বেশি মর্মান্তিক হয় যখন তা আড্রাণেও লাগে না-আস্বাদনেও লাগে না। পুরোপুরি অন্তত জীবিকার্জনটাই কর। দীনেশরঞ্জন হাত মেলালেন গোকুলের সঙ্গে। তার বিপণি-বীথি নতুন ছন্দে সাজিয়ে দিলেন, নতুন বাচনে আলাপ করতে লাগলেন হলে-হতে-পারে খদ্দেরদের সঙ্গে। ফুল না নাও অন্তত একটু হাসি একটু সৌজন্য নিয়ে যাও বিনি-পয়সায়। আর এমন মজা, যেই একটু সেই হাসি দেখেছ বা কথা শুনেছ, নিজেরও অলক্ষিতে কিনে বসেছ ফুল। দেখতে-দেখতে গোকুলের মরা গাঙে ভরা কোটালের জোয়ার এল। তবু যেন মন ভরে না। এমন কিছু নেই যার সৌরভ অল্পযায়ী বা অল্পজীবী নয়? যা শুকায় না, বাসি হয় না? আছে নিশ্চয়ই আছে। তার নাম শিল্প, তার নাম সাহিত্য। চলো আমর। সেই সৌরভের সওদা করি। হোন তিনি এ সৃষ্টির কারিক, তবু আমরা পরের জিনিসে কারবার করব কেন? আমরা আমাদের নিজের জিনিস। নিজেরাই নির্মাণ করব।
সেই থেকে ফোর আর্টস বা চতুষ্কলা ক্লাব। আর সেই চতুষ্কলার ক্ষীরবিন্দু কল্লোল।
মুরলীদা শৈলজা প্রেমেন আর আমি চারজন ভবানীপুর থেকে এক দলে, আর অন্য দলে ডি-আর গোকুল নৃপেন ভূপতি পবিত্র সুকুমার সকলে সদলবলে হুগলিতে এসে উপস্থিত হলাম। প্ল্যাটফর্মে স্বয়ং নজরুল। দে গরুর গা ধুইয়ে অভিনন্দনের ধ্বনি উঠল। পূর্ব-পরিচয়ের নজির এনে ব্যবধানটা কমাবার চেষ্টা করা যায় কিনা সে-কথা ভেবে নেবার আগেই নজরুল সবল আলিঙ্গনে বুকে টেনে নিলে—শুধু আমাকে নয়, ভনে-জনে প্রত্যেককে। তোমরা হেঁটে-হেঁটে একটু-একটু করে কাছে আস আর আমি লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে পড়ে জাপটে ধরি–সাঁতার জানা থাকতে সাঁকোর কি দরকার।
সেটা বোধ হয় নজরুলের বড় ছেলের আকিকা উৎসবের নিমন্ত্রণ। দিনের বেলায় গানবাজনা, হৈ-হল্লা, রাতে ভুরিভোজ। ফিরতি ট্রেন কখন তারপর? দে গরুর গা ধুইয়ে। ফিরতি ট্রেনের কথা ফিরতি ট্রেনকে জিগগেস করো।
দুপুরে নজরুলকে নিয়ে কেউ-কেউ চলে গেলাম নৈহাটি—সুবোধ রায়ের বাড়ি। সুবোধ রায় মুরলীদার সহপাঠী, তাছাড়া সেই বছরেই তার আর সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের হাতে এসে গিয়েছে বিজলী–মহানিশার অন্ধকারে সেই বিদ্যুজ্জ্বালাময়ী কথা। আর তার সঙ্গে আছে কিরণকুমার রায়, সংক্ষেপে কিকুরা। তীক্ষ্ণধী সুজন-রসিক বন্ধু। কিন্তু সে নিজের আত্মপরিচয় দিতে ভালবাসে চিরকেলে সাব-এডিটর বলে। বলেই বয়েৎ ঝাড়ে : এডিটর মে কাম, এডিটর মে গো, বাট আই গো অন ফর এভার। আরো একজন আছেন—তিনি শিল্পী নাম অরবিন্দ দত্ত, সংক্ষেপে এ-ডি। নিপুণ রূপদক্ষ। কিন্তু তিনি বলেন, তার শিল্পের আশ্চর্য কৃতিত্ব তার রঙে-তুলিতে-কাগজে-কলমে তত নয়, যত তার আননমণ্ডলে। কেননা উত্তরকালে তিনি বহু সাধনায় তার মুখোনাকে চাচিল সাহেবের মুখ করে তুলেছেন। দাঁতের ফাঁকে একটা মোটা চুরুট শুধু বাকি।
ছোটখাটো বেঁটে মানুষটি এই সুবোধ রায়, অফুরন্ত উচ্চহাস্যের ও উচ্চরোলের ফোয়ারা। প্রচুর পান খান আর প্রচুর কথা বলেন। আর, উচ্চগ্রামের সেই কথায় আর হাসিতে নিজেকে অজস্র ধারায় অবারিত করে দেন। আজো, বহু বৎসর অতিক্রম করে এসেও, সেই সরল খুশির সবল উৎসার যেন এখনো শুনতে পাচ্ছি।
আসলে সেই যুগটাই ছিল বন্ধুতার যুগ, কমরেডশিপ বা সমর্মিতার যুগ। যে যখন যার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, আত্মার আত্মজনের মত দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞাসা নেই, পরীক্ষা নেই, ব্যবধান নেই। সৃজনসমুদ্রের উর্মিল উত্তালতায় এক ঢেউয়ের গায়ে আরেক ঢেউ-ঢেউয়ের পরে ঢেউ। সব এক জলের কলোচ্ছ্বাস! বাঁধ ভাঙা এক বন্যার বল।
কল্লোল-যুগের আরেক লক্ষণ এই সুন্দর সৌহার্দ্য, নিকটনিবিড় আত্মীয়তা। একজনের জন্যে আরেকজনের মনের টান। একজনের ডাকে আরেকজনের প্রতিধ্বনি। এক সহমর্মিতা।
নজরুল বিষের বাঁশি বাজাচ্ছে, আর সে-সুর সে-কথা সবাইর রক্তে বিদ্রোহের দাহ সঞ্চার করছে। গলার শির জোঁকের মত ফুলে উঠেছে, ঝাঁকড়া-চুলে মাথা দোলাচ্ছে অনবরত, আর কখনো-কখনো চড়ার কাছে গিয়ে গলা চিরে যাচ্ছে দুতিন ভাগ হয়ে—সব মিলে হয়ত একটা অশালীন কর্কশতা—কিন্তু সব কিছু অতিক্রম করে সেই উন্মাদনার মাধুর্য–ইহসংসারে কোথাও তার তুলনা নেই। প্রখরতার মধ্যে সে যে কি প্রবলতা, কার সাধ্য তা প্রতিরোধ করে! কার সাধ্য সে অগ্নিমন্ত্রে না দীক্ষা নেয় মনে-মনে! এ তো শুধু গান নয় এ আহ্বান-বন্ধনবর্জনের আর্তনাদ! কার সাধ্য কান পেতে না শোনে! বুক পেতে না গ্রহণ করে।
এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল!
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।
তোদের বন্ধ-কারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয়,
ওরে, ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন-ভয়।
এই বাঁধন পরেই বাঁধন তোদের করব মোরা জয়
এই শিকল-বাঁধা পা নয় এ শিকল ভাঙা কল।।
ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন এই শিকল ঝঞ্চনা
এ যে মুক্তি পথের অগ্রদূতের চরণবন্দনা।
এই লাঞ্ছিতেরাই অত্যাচারকে হানছে লাঞ্ছনা,
মোদের অস্থি দিয়েই জ্বলবে দেশে আবার বজ্রানল।।
একবার গান আরম্ভ করলে সহজে থামতে চায় না নজরুল। আর কার এমন ভাবের অভাব হয়েছে যে নজরুলকে নিবৃত্ত করে। হারমোনিয়মের রিডের উপর দিয়ে খটাখট খটাখট করে ক্ষিপ্তবেগে আঙুল চালার আর দীপ্তস্বরে গান ধরে :