নজরুলের বিদ্রোহ, প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা ও আত্মভোলা বন্ধুত্বের পরিচয় পেলাম। তারপরে স্বাদ পাব তার দারিদ্রজয়ী মুক্ত প্রাণের আনন্দ, বিরতিহীন সংগ্রাম ও দায়িত্বহীন বোহিমিয়ানিজম! সবই সেই কল্লোলযুগের লক্ষণ।
কিন্তু তোমরা কে কি করে এলে কল্লোলে?
নৃপেন হঠাৎ একদিন একটা দীর্ঘ প্রেমপত্র পায়—তুমি এসো, আমার হাতের সঙ্গে হাত মেলাও। এ প্রেমপত্র তাকে কোনো তরুণী লেখেনি, লিখেছে কল্লোলের পরিকল্পক স্বয়ং দীনেশরঞ্জন। ধূমকেতুতে ত্রিশূলের লেখায় আকৃষ্ট হয়েই দীনেশরঞ্জন নৃপেনকে সম্ভাষণ করেন–আর, শুধু একটা লেখার জন্যে অনুরোধ নয়, গোটা লোকটাকেই নিমন্ত্রণ করে বসলেন। ভোজ্য সাজাতে, পরিবেশন করতে। নৃপেন চলে এল সেই ডাকে। মুখে সেই মধুর মন্দাক্রান্তা ছন্দ—
ছন্নোপান্তঃ—পরিণতফল—দ্যোতিভিঃ কাননাম্রৈ-
স্ত্বয্যারূঢ়ে—শিখরমচলঃ—স্নিগ্ধবেণীসবর্ণে।
নূনং যাস্য–ত্যমবমিথুন—প্রেক্ষণীয়ামবস্থাং
মধ্যে শ্যামঃ–স্তন ইব ভুবঃ–শেষবিস্তারপাণ্ডুঃ।।
আর, পবিত্র একদিন ফোর আর্টস বা চতুষ্কলা ক্লাবে এসে পড়েছিল ওমরখৈয়ামের কবি কান্তিচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে। পুরানো ঘর ভেঙে যখন ফের নতুন ঘর বাঁধা হল, ছোট করে, বন্ধুতায় ঘন ও দৃঢ় করে, তখনও পবিত্রর ডাক পড়ল। ঘর ছোট কিন্তু টুই খুব উঁচু। সে চূড়া উঁচু আদর্শবাদের।
কান্তিচন্দ্র ঘোষকে দুর থেকে মনে হত সুকৃত্রিম আভিজাত্যের প্রতীক। এক কথায় স্নব। তিনিও নিজেকে dilettante বলতেন। বিচিত্রায় থাকা কালে তার সংস্পর্শে আসি। তখন বুঝতে পারি কত বড় রসিক কত বড় বিদগ্ধ মন তার। তিনি সবুজপত্রের লোক। তাই সাহিত্যে সব সময় নব্যপন্থী, অচলায়তনী নন। রসবোধের গভীরতা থেকে মনে যে স্নিগ্ধ প্রশান্তি আসে তা তার ছিল—সে শান্তির স্বাদ পেয়েছে তার নিকটবর্তীরা।
কিন্তু নজরুল এল কি করে?
পবিত্র যখন জেলে নজরুলকে বসন্ত দিতে যায় তখনই নজরুল কথা দেয় নতুন কবিতা লিখবে পবিত্রর ফরমায়েসে। কল্লোলের জন্যে কবিতা। লাল কালিতে লেখা কবিতা। জেল থেকে এল একদিন সেই কবিতা—সত্যিসত্যিই লাল কালিতে লেখা–সৃষ্ট সুখের উল্লাসে।
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে।
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার-ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি আসল কাঁদন, আসল মুক্তি আসল বাঁধন;
মুখ ফুটে আজ, বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে,
রিক্ত বুকের দুখ আসে–
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।।
এই কবিতা ছাপা হল কল্লোলের প্রথম কি দ্বিতীয় সংখ্যায়। কবিতাটির জন্যে পাঁচ টাকা দেওয়া হয়েছিল। জেলে সেই টাকা পবিত্র পৌঁছে দিয়েছিল নজরুলকে।
এমন সময় কল্লোল-আপিসে কে আরেকটি যুবক এসে ঢুকল। ছিপছিপে ফর্সা চেহারা, খাড়া নাক, বড়-বড় চোখ, মুখে স্নিগ্ধ হাসি। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই বয়সেই কপালের উপর দু-চারটি রেখা বেশ গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। কে এ? এ সুকুমার ভাদুড়ি। একদিন এক গ্রীষ্মের দুপুরে হঠাৎ অনাহুত ভাবে কল্লোল-আপিসে চলে আসে। একটা গল্প হয়তো বেরিয়েছিল কল্লোলে—সেই অধিকারে। এসে নিঃসংকোচে দীনেশ ও গোকুলকে বললে, আমি আপনাদের দেখতে এসেছি। আর ঘরের এক কোণে নিজের জায়গাটি পাকা করে রেখে যাবার সময় বললে, আমি কল্লোলের জন্যে কাজ করতে চাই।
আনন্দের খনি এই সুকুমার ভাদুড়ি। কিন্তু কপালে ঐ দুশ্চিন্তার রেখা কেন? এমন সুন্দর সুকান্ত চেহারা, এমন স্নিগ্ধ উজ্জ্বল চক্ষু, কিন্তু বিষাদের প্রলেপ কেন?
নৃপেন বললে, এখন এসব থাক। এখন হুগলি চলো।
বলে, এখন, এতক্ষণে রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করলে :
হে অলক্ষ্মী, রুক্ষকেশী, তুমি দেবী অচঞ্চলা
তোমার রীতি সরল অতি নাহি জানো ছলাকল।
জ্বালাও পেটে অগ্নিকণা, নাইকো তাহে প্রতারণা
টানো যখন মরণ ফাঁসি বলো নাকো মিষ্টভাষ,
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করবো মোরা পরিহাস।
০৬. ঝড়ের রাতের বন্ধু দীনেশরঞ্জন দাশ
আপনি যাবেন না?
তোমার কি মনে হয়? দুই চোখে কথা-ভরা হাসি নিয়ে তাকালেন দীনেশদা।
উজ্জ্বল দৃষ্টির মধ্য দিয়ে এমন বন্ধুতাপূর্ণ হাসি-এ আর দেখিনি কোনোদিন। সে-হাসিতে কোমল স্নেহের স্পর্শ মাখানো। পুঁজিপাটা তার কিছুই ছিল না—শুধু হৃদয়ভরা নীরবনিবিড় স্নেহ আর দুই চোখের এই মাধুৰ্যময় মিত্রতা। যেন বা একটি অন্তিম অশ্রিয়ের প্রশ্নহীন প্রতিশ্রুতি। সব হারিয়ে-ফুরিয়ে গেলেও আমি আছি এই অভয় ঘোষণা। তাই দীনেশরঞ্জন ছিলেন কল্লোলের সব-পেয়েছির দেশ। সব-হারানোদের মধ্যমণি।
দেখতে সুপুরুষ ছিলেন। চৌরঙ্গি অঞ্চলে এস রায়ের খেলার সরঞ্জামের দোকানে যখন চাকরি করতেন, তখন সবাই তাঁকে পার্শি বলে ভুল করত। দু চার কথা আলাপ করেই বোঝা যেত ইনি যে শুধু বাঙালি তা নন, একেবারে বিশ্বাসী বন্ধুস্থানীয়। অল্প একটু হেসে দুচারটি মিষ্টি কথায় দুরকে নিকট ও পরকে আপন করার আশ্চর্য জাদুমন্ত্র জানতেন। একটি বিশুদ্ধ প্রীতিস্বচ্ছ অন্তরের নির্ভুল ছায়া এসে সে চোখে পড়ত বলেই সে-জাদুমন্ত্রের মায়ায় মুগ্ধ না হয়ে থাকা যেত না। এস রায়ের দোকান থেকে চলে আসেন তিনি লিসে স্ট্রিটে এক ওষুধের দোকানে অংশীদার হয়ে। সমবেত রুগীদের এমন ভাবে যত্ন-আত্তি করতেন কে বলবে ইনিই ডাক্তার নন। মানুষের অন্তরে প্রবেশ করবার সহজ, সংক্ষিপ্ত ও ত্বরান্বিত যে পথ আছে তিনি ছিলেন সেই পথের পথকার। সে পথের প্রবেশে স্বচ্ছ-স্নিগ্ধ হাসি, প্রস্থানে অকপট আন্তরিকতা। এই সময়ে প্রায়ই নিউ মার্কেটে ফুলের স্টলে বেঁড়াতে আসতেন। ফুল ভালবাসতেন খুব, কিন্তু কেনবার মত স্বচ্ছলতা ছিল না। মাসে দু-এক টাকার কিনতেন বড় জোর, কিন্তু যখনই দোকানের গলিতে এসে ঢুকতেন দোকানীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত—কে কোন ফুল তাকে উপহার দেবে। অম্লান ফুলের মতই যে এর হৃদয় ফুলের জহুরিরা বুঝতে পারত সহজেই। কথা-ভরা উজ্জ্বল চোখ, হাসিভরা মিষ্টি আলাপ আর অনন্যসাধারণ সরল সৌন্দর্যবোধ—সকলের থেকেই কিছু না কিছু আদায় করে নিত অনায়াসে। শুধু ক্ষণজীবনের ফুল নয়, আমার-তোমার ইহজীবনের ভালোবাসা। অজাতশত্রু শুনেছি, কিন্তু এই প্রথম দেখলাম—জাতমিত্র। এই একজন।