নজরুল মিঠে পান ও জর্দা ভালোবাসে, আর ভালোবাসে হেজলিন স্নো। এই সব ও আরো কটা কি বরাতী জিনিস নিয়ে পবিত্র একদিন আলিপুর সেণ্টাল জেলের দুয়ারে হাজির, নজরুলের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে। লোহার বেড়ার ওপার থেকে নজরুল চেঁচিয়ে জিগগেস করলে—সব এনেছিস তো? পবিত্র হাসল। কী জানে নজরুল, কী জিনিন পবিত্র আজ নিয়ে আসছে তার জন্যে। কী দেবতা-দুর্লভ উপহার! কী এনেছিস? চেঁচিয়ে উঠল নজরুল। পবিত্র বললে, তোর জন্যে কবিকণ্ঠের মালা এনেছি। বলে বসন্ত বইখানা তাকে দেখাল। নজরুল ভাবলে, রবীন্দ্রনাথের বসন্ত কাব্যনাট্যখানা নিমেই পবিত্র বুঝি একটু কবিয়ানা করছে। এই দ্যাখ। উৎসর্গ-পৃষ্ঠটা পবিত্র খুলে ধরল তার চোখের সামনে। আর কী চাস! সব চেয়ে বড় স্তুতি আজ তুই পেয়ে গেলি। তার চেয়েও হয়তো বড় জিনিস। রবীন্দ্রনাথের স্নেহ!
রবীন্দ্রনাথ যে নজরুলকে দেশের ও সাহিত্যের একটা দামী সম্পদ বলে মনে করতেন তার আর একটা প্রমাণ আছে। নজরুল যখন হুগলি জেলে অনশন করছে তখন রবীন্দ্রনাথ ব্যস্ত হয়ে তাকে টেলিগ্রাম করেছিলেন–Give up hunger strike, our literature claims you. টেলিগ্রাম করেছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে। সেই টেলিগ্রাম ফিরে এল রবীন্দ্রনাথের কাছে। কর্তৃপক্ষ লিখে পাঠাল : Addressee not found।
এই সময়ে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। পবিত্র তা চেপে যাচ্ছে। বললেন নলিনীকান্ত সরকার, আমাদের নলিনী। কৃষ্ণের যেমন বলরাম, নজরুলের তেমনি নলিনীদা। হাসির গানের তানসেন। নজরুল গায় আর হাসে, নলিনীদা গান আর হাসান। নজরুলের পার্শ্বাস্থি বলা যেতে পারে। নজরুলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, নলিনীদার কাছে সন্ধান নাও। নজরুলকে সভায় নিয়ে যেতে হবে, নলিনীদাকে সঙ্গে চাই। নজরুলকে দিয়ে কিছু করাতে হবে, ধরো নলিনীদাকে। নজরুল সম্বন্ধে সব চেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল।
শোনো সে মজার কথা। আলিপুর সেণ্টাল জেল থেকে নজরুল তখন বদলি হয়েছে হুগলি জেলে। হুগলি জেলে এসে নজরুল জেলের শৃঙ্খলা ভাঙতে শুরু করল, জেলও চাইল তার পায়ে ভালো করে শৃঙ্খল পরাতে। লেগে গেল সংঘাত। শেষকালে নজরুল হাঙ্গার স্ট্রাইক করলে। আটাশ দিনের দিন সবাই আমাকে ধরলে জেলে গিয়ে নজরুলকে যেন খাইয়ে আসি। জানতাম নজরুল মচকাবার ছেলে নয়, তবু ভাবলাম একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি। গেলাম হুগলি জেলের ফটকে। আমি আর সঙ্গে, সকল অগতির গতি, এই পবিত্র। জেলে ঢুকতে পারলাম না, অনুমতি দিলে না কর্তারা। হতাশ মনে ফিরে এলাম হুগলি স্টেশনে। হঠাৎ নজরে পড়ল, প্ল্যাটফর্মের গা ঘেঁসেই জেলের পাঁচিল উঠে গেছে। মনে হল জেলের পাঁচিলটা একবার কোনোরকমে ডিঙোতে পারলেই নজরুলের সামনে সটান চলে যেতে পারব। আর এভাবে জেলের মধ্যে একবার ঢুকতে পারলে সহজে যে বেরুনো চলবে না তা এই দিনের আলোর মতই স্পষ্ট। তবু বিষয়টা চেষ্টা করে দেখবার মত। পবিত্রকে বললাম, তুমি আগে উবু হয়ে বোসো, আমি তোমার দু কাঁধের উপর দু পা রেখে দাঁড়াই দেয়াল ধরে। তারপর তুমি আস্তে-আস্তে দাঁড়াতে চেষ্টা করো। তোমার কাঁধের থেকে যদি একবার লাফ দিয়ে পাঁচিলের উপর উঠতে পারি, তবে তুমি আর এখানে থেকো না। স্রেফ হাওয়া হয়ে যেয়ো। বাড়তি আরেক জনের জেলে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।
বেলা তখন প্রায় দুটো, প্ল্যাটফর্মে যাত্রীর আনাগোনা কম। য়্যাকর্ডিং টু প্ল্যান কাজ হল। পবিত্রর কাঁধের থেকে পাঁচিলের মাথায় কায়ক্লেশে প্রমোশন পেলাম। প্রমোশন পেয়েই চক্ষু চড়কগাছ! ভিতরের দিকে প্রকাণ্ড খাদ—খাই প্রায় অন্তত চল্লিশ হাত। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি পবিত্রর নামগন্ধ নেই। যা হবার তা হবে, দুদিকে দু ঠ্যাং ঝুলিয়ে জাঁকিয়ে বসলাম পাঁচিলের উপর ঘোড়সওয়ারের মত। যে দিকে নামাও সেই দিকেই রাজি আছি—এখন নামতে পারাটাই কাম্যকর্ম। কিন্তু কই জেলখানার ভিতরের মাঠে লোক কই? খানিকপর সামধ্যায়ী মশাইকে দেখলাম—মোক্ষদাচরণ সামধ্যায়ী। বেড়াতে বেড়াতে একটু কাছে আসতেই চীৎকার করে বললাম, নজরুলকে ডেকে দিন। নজরুলকে।
সার্কাসের ক্লাউন হয়ে বসে আছি পাঁচিলের উপর। জেলখানার কয়েদীরা দলে-দলে এসে মাঠে জুটতে লাগলো বিনা টিকিটে সে-সার্কাস দেখবার জন্যে। দুটি বন্দী যুবকের কাঁধে ভর দিয়ে দুর্বল পায়ে টলতে টলতে নজরুলও এগিয়ে আসতে লাগল। বেশি দূর এগুতে পারল না, বসে পড়ল। গলার স্বর অতদূরে পৌঁছুবে না, তাই জোড়হাত করে ইঙ্গিতে অনুরোধ করলাম যেন সে খায়। প্রত্যুত্তরে নজরুল ও জোড়হাত করে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল এ অনুরোধ অপাল্য।
এ তো জানা কথা। এখন নামি কি করে? পবিত্র সে ঠিক ধরো লক্ষ্মণের মতই অবিকল ব্যবহার করবে এ যেন আশা করেও আশা করিনি। গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার চেয়ে পাঁচিলে তুলে কাঁধ সরিয়ে নেওয়া ঢের বেশি বিপজ্জনক। কিন্তু ভয় নেই। স্টেশনের বাবুরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আমার চোদ্দপুরুষের-আদ্য কি করে বলি—শেষ শ্রাদ্ধ করছেন। ধরণী, সিধা হও, বলে পাঁচিল থেকে পড়লাম লাফ দিয়ে। স্টেশনের মধ্যে আমাকে ধরে নিয়ে গেল, পুলিশের হাতে দেয় আর কি। অনেক কষ্টে বোঝানো হল যে আমি সন্ত্রাসবাদীদের কেউ নই। ছাড়া পেয়ে গেলাম। অবিশ্যি তার পরে পবিত্র আর কাছ-ছাড়া হল না
তারপরে নজরুল অনশন ভাঙল তো?
ভাঙল চল্লিশ দিনের দিন। আর তা শুধু তার মাতৃসমা বিরজাসুন্দরী দেবীর স্নেহানুরোধে।