কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট, শিকলপূজার পাষাণবেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান! বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ
ধ্বংশ-নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি!
গাজনের বাজনা বাজা! কে মালিক কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?
হাহাহা পায় যে হাসি, ভগবান পরবে ফাঁসি
সৰ্ব্বনাশী শিখায় এ হীন তথ্য কে রে?
ওরে ও পাগলা ভোলা, দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা জোরসে ধরে হেঁচকা টানে!
মার হাঁক হায়দরী হাঁক, কাঁধে নে দুন্দুভি-ঢাক
ডাক ওরে ডাক মৃত্যুকে ডাক জীবনপানে।
নাচে ঐ কালবোশেখী, কাটাবি কাল বসে কি?
দে রে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!
লাথি মার ভাঙরে তালা যত সব বন্দীশালা।
আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি।।
ধূমকেতুর সেসব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ সংকলিত থাকলে বাংলাসাহিত্যের একটা স্থায়ী উপকার হত। অন্তত সাক্ষ্য থাকত বাঙলা গদ্য কতটা কাব্যগুণান্বিত হতে পারে, প্রসন্নগম্ভীরপদা সরস্বতী কি করে বিনিষ্ক্রান্তাসিধারিণী সংহারকর্ত্রী মহাকালী হতে পারে। প্রসাদম্য ললিত ভাষায় কি করে উৎসারিত হতে পারে অগ্নিগর্ভ অঙ্গীকার। একটা প্রবন্ধের কথা এখনো মনে আছে—নাম, ম্যয় ভখাহুঁ। মহাকালী ক্ষুধার্ত হয়ে নরমুণ্ডের লোভে শ্মশানে বেরিয়েছেন তারই একটা ঘোরদর্শন বর্ণনা। বোধ হয় সে-সংখ্যাটা কালীপূজার সন্ধ্যায় বেরিয়েছিল। কালীপূজার দিন সাধারণ দৈনিক বা সাপ্তাহিক কাগজে যে মামুলি প্রবন্ধ বেরোয়—মুখস্তকরা কতকগুলো সমাসবদ্ধ কথা—এ সে জাতের লেখা নয়। দীপান্বিতার রাত্রির পরেই এ-দীপ নিবে যায় না। বাংলাদেশের চিরকালীন যৌবনের রক্তে এর দ্যুতি জতে থাকে।
ধূমকেতুতে একটা কবিতা পাঠিয়ে দিলাম। অর্থাৎ, একটা সাঁকো ফেললাম নজরুলকে গিয়ে ধরবার জন্যে। সেই কবিতাটা ঠিক পরবর্তী সংখ্যায় বেরুল না। অনুৎসাহিত হবার কথা, কিন্তু আমার স্পর্ধা হলো নজরুল ইসলামের কাছে গিয়ে মুখোমুখি জবাবদিহি নিতে হবে। গেলাম তাই একদিন দুপুরবেলা। রঙিন লুঙ্গি পরনে, গায়ে আঁট গেঞ্জি —অসম্পাদকীয় বেশে নজরুল বসে আছে তক্তপোশে—চারদিকে একটা অন্তরঙ্গতার আবহাওয়া ছড়িয়ে। অগ্নিবীণার প্রথম সংস্করণে নজরুলের একটা ফোটো ছাপা হয়েছিল, সেটায় বড় বেশি কবি-কবি ভাব—এখন চোখের সামনে একটা গোটা মানুষ দেখলাম, স্পষ্ট, সতেজ প্রাণপূর্ণ পুরুষ। বললাম, আমার কবিতার কি হল? নজরুল চোখ তুলে চাইল। কোন কবিতা? বললাম—আপনার কবিতা যখন বিদ্রোহী, আমার কবিতা উচ্ছৃঙ্খল। হাহাহা করে নজরুল হেসে উঠল। বললে–আপনি মনোনীত হয়েছেন।
কবিতাটা ছাপা হয়েছিল কিনা জানি না। হয়তো হয়েছিল, কিংবা হয়তো তার পরেই নজরুলকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশে। কিন্তু তার সেই কথাটা মনের মধ্যে ছাপা হয়ে রইল : আপনি মনোনীত হয়েছেন।
নজরুলকে কিসের জন্যে ধরলে জানো? জিগগেস করলে নৃপেন।
কিসের জন্যে?
আগে লিখেছিল—রক্তাম্বর পর মা এবার জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেতবসন। দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন বাজে তরবারি ঝনন ঝন।। এবারে লিখলে—আর কতকাল রইবি বেটি মাটির ঢেলার মুর্তি-আড়াল? স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল! এই লেখার জন্যে নজরুলের এক বছর জেল হয়ে গেল। সে যা জবানবন্দি দিলে তা শুধু সত্য নয়, সাহিত্য।
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বসে ছিল একপাশে! বললে, তার জেলের কাহিনীটা আমার কাছ থেকে শোনো।
তোমার সঙ্গে নজরুলের আলাপ হল কবে?
নজরুল যখন করাচিতে, যখন ও শুধু-কবি নয়, হাবিলদার কবি। পল্টনে লেফট-রাইট করাতে হত তাকে। পল্টনও এমন পল্টন, লেফটরাইট বোঝে না। তখন এক পায়ে ঘাস ও অন্য পায়ে বিচালি বেঁধে দিয়ে বলতে হত, ঘাস-বিচালি ঘাস। সেই সময়কার থেকে চেনা। আছি তখন সবুজপত্রে—হঠাৎ অপ্রত্যাশিত এক চিঠি আসে করাচি থেকে, সঙ্গে ছোট একটি কবিতা। লেখক উনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি পল্টনের একজন হাবিলদার, নাম কাজী নজরুল ইসলাম। কবিতাটি বড় রবীন্দ্রনাথ-ঘেঁসা। স্বকীয়তা খুঁজে পেলেন না বলে চৌধুরী মশায়ের পছন্দ হল না। আমার কিন্তু ভাল লেগেছিল। কবিতাটি নিয়ে গেলাম প্রবাসীর চারুবাবুর কাছে। চারুবাবু খুশি হয়ে ছাপলেন সে-কবিতা। বললেন, আমরা চাই। এক জায়গায় পাঠানো কবিতা অন্য জায়গায় চালিয়ে দিয়েছি লেখকের সম্মতি না নিয়ে, কুণ্ঠিত হয়ে চিঠি লিখলাম নজরুলকে। দে গরুর গা ধুইয়ে–নজরুল তা থোড়াই কেয়ার করে। প্রশস্ত সাধুবাদ দিয়ে চিঠি লিখলে আমাকে, এতটুকু ভুল বুঝলে না। নবীন আগন্তুককে প্রবেশ-পথে যে সামান্য সাহায্য করেছি এতেই তার বন্ধুতা যেন সে কায়েম করলে। তারপর পল্টন ভেঙে দেবার পর যখন সে কলকাতায় ফিরল, ফিরেই ছুটল সবুজপত্রে আমাকে খোঁজ করতে–
একদিন জোড়াসাঁকো থেকে খবর এল—রবীন্দ্রনাথ পবিত্রকে ডেকেছেন। কি ব্যাপার? ব্যাপার রোমাঞ্চকর। রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত-নাটিকাটি নজরুলের নামে উৎসর্গ করেছেন। এখন একখানা বই ওকে জেলখানায় পৌঁছে দেওয়া দরকার। পারবে নাকি পবিত্র?
নিশ্চয়ই পারব। উৎসর্গ-পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ নিজের নাম লিখে দিলেন। উৎসর্গ-পৃষ্ঠায় ছাপা ছিল : শ্ৰীমান কবি কাজি নজরুল ইসলাম, কল্যাণীয়েষু। তার নিচে তার কাঁচা কালির স্বাক্ষর বসল। শুনেছি তার আশেপাশে যে সব উন্নাসিক ভক্তের দল বিরাজ করত তার কবির এই বদান্যতায় সেদিন বিশেষ খুশি হতে পারেনি। কিন্তু তিনি নিজে তো জানতেন কাজী নজরুল তারই পরেকার যুগে প্রথম স্বতন্ত্র কবি, স্বীকার করতে হবে তার এই শক্তিদীপ্ত বিশিষ্টতাকে। তাই তিনি তার অন্তরের স্নেহ ও স্বীকৃতি জানাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না। শ্রীমান ও কবি এই কথা দুটির মধ্যে তার সেই গভীর স্নেহ ও আন্তরিকতা অক্ষয় করে রাখলেন।