বললাম, কি করে চিনলে নজরুলকে?
নৃপেন তখন সিটি কলেজে আই-এ পড়ে ও আরপুলি লেনের এক বাড়িতে ছাত্র পড়ায়। দু-তিনখানা বাড়ির পরেই কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচির বাড়ি। সে সব দিনে-তখন সেটা ১৩২৮ সাল-বাগচি-কবির বৈঠকখানায় কলকাতার একটা সেরা সান্ধ্য মজলিস বসত। বহু গুণী—গায়ক ও সাহিত্যিক—সে-মজলিসে জমায়েত হতেন। বাংলা দেশের সব জ্যোতির্ময় নক্ষত্র–গ্রহপতি স্বয়ং যতীন্দ্রমোহন। যতীন্দ্রমোহনের অতিথিবৎসল্য নগরবিশ্রুত। কোথায় কোন ভাঙা দেয়ালের আড়ালে নূতনের কেতন উড়ছে, কোথায় কার মাঝে মৃদুতম সম্ভাবনা, ক্ষীণতম প্রতিশ্রুতি—সব সময়ে তার চোখ-কান খোলা ছিল। আভাস একবার পেলেই উদ্বেল হৃদয়ে আহ্বান করে আনতেন। তার বাড়ির দরজায় যে হাসনাহেনার গুচ্ছ ছিল তার গন্ধ প্রীতিপূর্ণ হৃদয়ের গন্ধ। নৃপেন দু-দুবার সে বাড়ির সুমুখ দিয়ে হেঁটে যায়, আর ভাবে, ঐ স্বর্গরাজ্যে তার কি কোনদিন প্রবেশের অধিকার হবে? আদৰ্শতাড়িত যুবক, সাংসারিক দারিদ্র্যের চাপে সামান্য টিউশনি করতে হচ্ছে, বাগচিকবি কি করে জানবেন তার অন্তরের সীমাতিক্রান্ত অনুরাগ, তার নির্জনলালিত বিদ্রোহের ব্যাকুলতা? নৃপেন যায় আর আসে, আর ভাবে, ঐ স্বর্গরাজ্যে কে তাকে ডাক দেবে, কবে, কার কণ্ঠরে?
একদিন তার ছাত্র নৃপেনকে বললে, জানেন মাস্টার মশাই, আজ বাগচি-বাড়িতে বিদ্রোহীর কবি কাজী নজরুল ইসলাম আসছেন। বিদ্রোহীর কবি! আমি ইন্দ্রাণী-সুত, হাতে চাঁদ ভালে সূৰ্য্য; মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতুৰ্য্য। আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন; আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন। সেই বিদ্রোহীর কবি? কেমন না জানি দেখতে! রাস্তার উপরে উৎসুক জনতা ভিড় করে আছে আর ঘরের মধ্যে কে একজন তরুণ গান গাইছে তারস্বরে। সন্দেহ কি, শুধু বিদ্রোহীর কবি নয়, কবি-বিদ্রোহী। তার কণ্ঠস্বরে প্রাণবন্ত প্রবল পৌঁরুষ, হৃদয়স্পনী আনন্দের উত্তালতা। গ্রীষ্মের রুক্ষ আকাশে যেন মনোহর ঝড় হঠাৎ ছুটি পেয়েছে। কর্কশের মাঝে মধুরের অবতারণা। নিজেরো অলক্ষ্যে কখন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে নৃপেন। সমস্ত কুণ্ঠার কালিমা নজরুলের ___নে মুছে গেছে। শুধু কি তাই? গানের শেষে অতর্কিতে সাহিত্যালোচনায় যোগ দিয়ে বসেছে নৃপেন। কথা হচ্ছিল রুশ সাহিত্য নিয়ে, সব সুমহান পূর্বসূরিদের সাহিত্য-পুশকিন, টলস্টয়, গোগল, ডস্টয়ভস্কি। নৃপেন রুশ সাহিত্যে মশগুল, প্রত্যেকটি প্রখ্যাত বই তার নখমুকুরে। তা ছাড়া সেই তরুণ বয়সে সব সময় নিজেকে জাহির করার উত্তেজনা তো আছেই। কে যেন ডস্টয়ভস্কির কোন উপন্যাসের চরিত্রের নামে ভুল করেছে, নৃপেন তা সবিনয়ে সংশোধন করলে। সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ করলে তার প্রত্যক্ষ পরিচয়ের বিস্তৃতি। সকলের বিস্মিত চোখ পড়ল নৃপেনের উপর। নজরুলের চোখ পড়ল নবীন বন্ধুতার।
ঘর থেকে নেমে এসেছে পথে, পিছন থেকে কে ডাকল নৃপেনকে। কি আশ্চর্য! বিদ্রোহী কবি স্বয়ং, আর তার সঙ্গে তার বন্ধু আফজল-উল হক—মোসলেম ভারতের কর্ণধার। মানে, যে কাগজে বিদ্রোহী ছাপা হয়েছে সেই কাগজের। সুতরাং নৃপেনের চোখে আফজল ও প্রকাণ্ড কীর্তিমান। আর, প্রবাসীর যেমন রবীন্দ্রনাথ, মোসলেম ভারতের তেমনি নজরুল।
নজরুল বললে, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
তা হলে আসুন, হাঁটি।
নৃপেন তখন থাকে চিংড়িঘাটায়, কলকাতার পূর্ব উপান্তে। নজরুল আর আফজল চলে এল নৃপেনের বাড়ি পর্যন্ত। নৃপেন বললে, আপনারা পথ চিনে ফিরতে পারবেন না, চলুন এগিয়ে দিই। এগিয়ে দিতে দিতে চলে এল কলেজ স্ট্রিট, নজরুলের আস্তানা। এবার ফিরি, বলে নৃপেন। নজরুল বললে, চলুন, ফের এগিয়ে দিই আপনাকে।
সে কি কথা? নজরুল বললে, পথ তো চিনে ফেলেছি ইতিমধ্যে।
রাত গভীর হয়ে এল, সঙ্গে-সঙ্গে গভীর হয়ে এল হৃদয়ের কুটুম্বিতা। দৃঢ় করে বাঁধা হয়ে গেল গ্রন্থি।
নজরুল বললে, ধুমকেতু নামে এক সাপ্তাহিক বের করছি। আপনি আসুন আমার সঙ্গে। আমি মহাকালের তৃতীয় নয়ন, আপনি ত্রিশূল! আসুন, দেশের ঘুম ভাঙাই, ভয় ভাঙাই–
নৃপেন উৎসাহে ফুটতে লাগল। বললে, এমন শুভকাজে দেবতার কাছে আশীর্বাদ ভিক্ষা করবেন না? তিনি কি চাইবেন মুখ তুলে? তবু নজরুল শেষমুহূর্তে তাঁকে টেলিগ্রাম করে দিল। রবীন্দ্রনাথ কবে কাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন? তা ছাড়া, এ নজরুল, যার কবিতায় পেয়েছেন তিনি তপ্ত প্রাণের নতুন সজীবতা। শুধু নামে আর টেলিগ্রামেই তিনি বুঝতে পারলেন ধূমকেতুর মর্মকথা কি। যৌবনকে চিরজীবী আখ্যা দিয়ে বলাকায় তিনি আধ-মরাদের ঘা মেরে বাঁচাতে বলেছিলেন, সেটাতে রাজনীতি ছিল না, কিন্তু, এবার ধূমকেতুকে তিনি যা লিখে পাঠালেন তা স্পষ্ট রাজনীতি, প্রত্যক্ষ গণজাগরণের সঙ্কেত।
আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন,
অলক্ষণের তিলকরেখা
রাতের ভালেহোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্দ্ধচেতন।
সাত নম্বর প্রতাপ চাটুজ্জের গলি থেকে বেরুল ধূমকেতু। ফুলস্কাপ সাইজ, চার পৃষ্ঠার কাগজ, দাম বোধ হয় দু পয়সা। প্রথম পৃষ্ঠায়ই সম্পাদকীয় প্রবন্ধ, আর তার ঠিক উপরে রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা ব্লক করে কবিতাটি ছাপানো।
নৃপেনের মত আমিও ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। সপ্তাহান্তে বিকেলবেলা আরো অনেকের সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, হকার কতক্ষণে ধূমকেতুর বাণ্ডিল নিয়ে আসে। হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কাগজের জন্যে। কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে ডুবিয়ে লেখা সেই সব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ। সঙ্গে ত্রিশূলের আলোচনা। শুনেছি স্বদেশ যুগের সন্ধ্যাতে ব্রহ্মবান্ধব এমনি ভাষাতেই লিখতেন। সে কী কশা, কী দাহ! একবার পড়ে বা শুধু একজনকে পড়িয়ে শান্ত করবার মত সে লেখা নয়। যেমন গদ্য তেমনি কবিতা। সব ভাঙার গান, প্রলয়-বিলয়ের মঙ্গলাচরণ।