পবিত্র বললে, এই শুভসংযোগ নিত্যকারের ঘটনা। দীনেশের এই মুক্ত দ্বার আর মেজবৌদির এই মুক্ত দাক্ষিণ্য।
একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে তবু থেকে যাচ্ছিল। বললাম, নজরুলের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি? ওকে কি করে চিনলে?
বা রে, ও যে আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আর-সবাই ডাকবে আমাকে শৈলজা বলে, ও ডাকবে শৈল বলে। পাশাপাশি দুই ইস্কুলে একই ক্লাশে পড়েছি আমরা। আমি রানিগঞ্জে, নজরুল শিয়াড়শোল রাজার ইস্কুলে। মাইল দুয়েকের ছাড়াছাড়ি। থার্ড ক্লাশে এসে মিললাম দুজনে, আমি হিন্দু ও মুসলমান, আমি লিখি কবিতা—আশ্চর্য হচ্ছ—ও লেখে গল্প। তবু মিললাম দুজনে। সেই টানে মিললাম, যে টানে ধর্মাধর্ম নেই বর্ণাবর্ণ নেই—সৃষ্টির টান, সাহিত্যের টান। দুইজনে বোজ একসঙ্গে মিলি, ঘুরে বেড়াই, গল্প করি, কোনোদিন বা স্কুল পালাই। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরি, ধরি ই-আই-আরের লাইন, কোনোদিন বা চলে যাই শিশু-শালের অরণ্যে। তখন ইংরেজ-জার্মানিতে প্রথম লড়াই লেগেছে। আমরা দুজনে ম্যাট্রিক ক্লাশে উঠে প্রি-টেস্ট দিচ্ছি। শহরে-গাঁয়ে চলেছে তখন সৈন্যজোগাড়ের তোড়জোড়। হাতে-গরম মুখে-গরম বক্তৃতা। সবাই এগিয়ে গেল বীরত্বের ঘোড়দৌড়ে, বাঙালি হিন্দুমুসলমানই শুধু পিছিয়ে থাকবে? বলে, বীর, চির-উন্নত মম শির! বলো বন্দে মাতরম!
দুই বন্ধু খেপে উঠলাম। পরীক্ষা দিয়েই দুজনে চুপিচুপি পালিয়ে গেলাম আসানসোল। সেখান থেকে এস-ডি-ওর চিঠি নিয়ে সটান কলকাতা। আসানসোলে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা—তার কাছে কিছু বাহাদুরি করতে গিয়েছিলাম কিনা মনে নেই—সে-ই বাড়ি ফিরে গিয়ে সব ভণ্ডুল করে দিলে। ঊনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি রেজিমেন্টে ঢোকার সব ঠিকঠাক, ডাক্তার বললে, তোমার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আরেকবার মাপতে হবে। দ্বিতীয়বারের মাপজোকে নামঞ্জুর হয়ে গেলাম। কেন যে নামঞ্জুর হলাম জানলেন শুধু ভগবান আর সেই রায়সাহেব দাদামশায়। নজরুলকে যুদ্ধে পাঠিয়ে সাথীহারা হয়ে ফিরে এলাম গৃহকোণে
তারপর কলেজে ঢুকলাম, অর্থাভাবে কলেজ ছাড়লাম। শিখলাম শর্টহাও-টাইপরাইটিং। চাকরি নিলম কয়লকুঠিতে। পোষাল না। শেষে এই সাহিত্য।
পাশা উলটো পড়েছিল ভাগ্যিস। তাই নজরুল করি, তুমি হলে গল্পলেখক।
এমন সময় মুরলীদার আবির্ভাব।
প্রথম আলাপ-পরিচয়ের উত্তাল ঢেউ। কেটে যাবার পর মুরলীদা বললে, আসছে রবিবার, পচিশে জ্যৈষ্ঠ, কাজীর ওখানে আমাদের সবাইর নেমন্তন্ন–
আমাদের সবাইকার? আমি আর প্ৰেমেন একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। যার সঙ্গে আলাপ নেই, তার ওখানে নেমন্তন্ন কি করে হতে পারে।
হ্যাঁ, সবাইকার। বললে মুরলীদা। সমস্ত কল্লোলের নেমন্তন্ন।
তা হলে তো আমাদেরও নেমন্তন্ন। নিঃসংশয়রূপে নিশ্চিন্ত হলাম। কল্লোলে তখনও লেখা এক আধটা ছাপা না হোক, তবু আমরা মনেপ্রাণে কল্লোলের।
বললাম, কোথায় যেতে হবে?
হুগলিতে। হুগলিতেই কাজী নজরুলের বাসা।
এই হুগলির বাসা উপলক্ষ্য করেই বুঝি কবি গোলাম মোস্তাফা লিখেছিল :
কাজী নজরুল ইসলাম
বাসায় একদিন গিছলাম।
ভায়া লাফ দেয় তিন হাত
হেসে গান গায় দিন রাত।
প্রাণে ফুতির ঢেউ বয়
ধরায় পর তার কেউ নয়।
এর পাল্টা-জবাবে নজরুল কি বলেছিল জানো?
গোলাম মোস্তফা
দিলাম ইস্তফা।
০৫. বিদ্রোহীর কবি কাজী নজরুল ইসলাম
কশ্চিৎ কান্তা-বিরহগুরুণা—স্বাধিকারপ্রমত্তঃ,
শাপেনাস্তং–গমিতমহিমা-বৰ্ষভোগ্যেন ভর্ত্তুঃ–
ললিতগভীর সুমধুর কণ্ঠে একটু বা টেনে-টেনে আবৃত্তি করতেকরতে যে যুবকটি কল্লোল-আফিসে প্রবেশ করল প্রথম দর্শনেই তাকে ভালোবেসে ফেললাম। ভালোবাসতে বাধ্য হলাম বলা উচিত। এমন হৃদয়স্পর্শী তার ব্যক্তিত্ব। মাথাভরা দীর্ঘ উস্কখুস্ক চুল, পারিপাট্যহীন বেশবাস। এক চোখে গাঢ় ভাবুকতা, অন্য চোখে আদর্শবাদের আগুন। এই আমাদের নৃপেন, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। সে যুগের যন্ত্রণাহত যৌবনের রমণীয় প্রতিচ্ছবি। কিন্তু দেখব কি তাকে। কয়েক চরণ বাদ দিয়ে পূর্বমেঘ থেকে সে আবার আবৃত্তি সুরু করেছে তার অমৃতবর্ষী মনোহরণ কণ্ঠে :
আষাঢ়স্য—প্রথমদিবসে—মেঘমাশ্লিষ্টসানু,
বপ্রক্রীড়া—পরিণতগজ—প্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।।
কতক্ষণ তুমুল আড্ডা জমাবার পর আবার সে হঠাৎ উদাস হয়ে পড়ল, চলে গেল আবার ভাবরাজ্যে। পূর্বমেঘ থেকে উত্তরমেঘে। আঙুল দিয়ে টেনে-টেনে চুলের ঘুরুলি তৈরি করছে আর আবৃত্তি করছে
তন্ময়ের মত :
হস্তে লীলা-কমলমলকে—বালকুন্দানুবিদ্ধং,
নীতা লোধ্র—প্রসবরজসা–পান্ডুমাননেশ্রীঃ।
চুড়াপাশে-নবকুরুবকং—চারু কর্ণে শিরীষং,
সীমন্তেচ—ত্বদুপগমজং-যত্র নীপং বধূনাম্।।
আবার কতক্ষণ হুল্লোড়, তর্কাতর্কি, আবার সেই ভাবুকের নির্লিপ্ততা। নৃপেন এতক্ষণ হয়তো দেয়ালে পিঠ রেখে তক্তপোশের উপর পা ছড়িয়ে বসে ছিল, এবার শুয়ে পড়ল। বলা-কওয়া নেই, সমুদ্র পেরিয়ে চলে গেল ইংরিজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগে, শেলির ওড টু ওয়েস্ট উইণ্ডে সুর মেলাল :
Make me Thy lyre! even as the forest is,
What if my thoughts are falling like its own,
The tumult of Thy mighty harmonies
Will take from both a deep autumnal tone
Sweet though in sadness—
জিগগেস করলাম, হুগলি যাবে না? নজরুল ইসলামের বাড়ি?
নিশ্চয়ই যাব। বলে নৃপেন নজরুলকে নিয়ে পড়ল।
ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর?
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
এই তো রে তার আসার সময় ঐ রথ-ঘর্ঘর–
শোনা যায় ঐ রথ-ঘর্ঘর!
বধূরা প্রদীপ তুলে ধর!
ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!