মেসের সেই ঘরের চারপাশে তাকালাম আশ্চর্য হয়ে। শৈলজার মত আরো অনেকে মেঝের উপর বিছানা মেলে বসেছে। চারধারে জিনিস পত্রের হাবজা-গোবজা। কারু-বা ঠিক শিয়রে দেয়ালে-বেঁধা পেরেকের উপর জুতা ঝুলানো। পাশ-বালিশের জায়গায় বাক্স-প্যাটরা। পোড়াবিড়ির জগন্নাথক্ষেত্র। দেখলেই মনে হয় কতগুলি যাত্রী ট্রেনের প্রতীক্ষায় প্ল্যাটফর্মে বসে আছে। কোথাকার যাত্রী? ধ্বংসপথের যাত্রী এরা।
নিজেরা যদিও অভাবে তলিয়ে আছি, তবু শৈলজার দুঃস্থতায় মন নড়ে উঠল। কী উপায় আছে, সাহায্য করতে পারি বন্ধুকে?
বললাম, কি করে তবে চালাবে? সম্বল কি তোমার? .
সম্বল? শৈলজা হাসল : সম্বলের মধ্যে লেখনী, অপার সহিষ্ণুতা আর ভগবানে বিশ্বাস।
তারপর গলা নামাল : আর স্ত্রীর কিছু অলঙ্কার, আর হাসি আর লক্ষ্মী নামে দুখানা উপন্যাস বিক্রির তুচ্ছ কটা টাকা।
কিন্তু কল্লোলে এলে কি করে?
কল্লোলে আসব না? শৈলজার দৃষ্টি উৎসাহে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কল্লোলে না এসে পারি? আজকের দিনে যত নতুন লেখক আছে স্তব্ধ হয়ে, সবাইর ভাষাই ঐ কল্লোল। সৃষ্টির কল্লোল, স্বপ্নের কল্লোল, প্রাণের কল্লোল। বিধাতার আশীর্বাদে তাই সবাই একত্র হয়েছি। মিলেছি এক মানসতীর্থে। শুধু আমরা কজন নয়, আরো অনেক তীর্থঙ্কর।
শোনো, কেমন করে এলাম। হঠাৎ কথা থামিয়ে প্রশ্ন করল শৈলজা : পবিত্রকে চেন? পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়?
চিনি না, আলাপ নেই। অনুবাদ করেন, দেখেছি মাসিকপত্রে।
চিনবে শিগগির। বিশ্বজনের বন্ধু এই পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। বুড়ো হোক, কচি হোক, বনেদী হোক, নিবনেদ হোক, সকল সাহিত্যিকের সে স্বজন-বান্ধব। শুধু মনে মনে নয়, পরিচয়ের অন্তরঙ্গ নিবিড়তায়। শুধু উপর-উপর মুখ-চেনাচেনি নয়, একেবারে হাঁড়ির ভিতরের খবর নিয়ে সে হাঁড়ির মুখের সরা হয়ে বসবে। একেবারে ভিতরের লোক, আপনার জন। বিশ্বাসে অনড়, বন্ধুতায় নির্ভেজাল। এদল-ওদল নেই, সব দলেই সমান মান। পূর্ববঙ্গে বর্ষার সময় পথ-ঘাট খেত-মাঠ উঠান-আঙিনা সব ডুবে যায়, এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে হলে নৌকো লাগে। পবিত্র হচ্ছে সেই নৌকো। নানারকম ব্যবধানে সাহিত্যিকরা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন এক সাহিত্যিকের ঘর থেকে আরেক সাহিত্যিকের ঘরে একমাত্র এই একজনই অবাধে যাওয়া আসা করতে পারে। এই একজনই সকল বন্দরের সদাগর।
আসল কথা কি জানো? লেশমাত্র অভিমান নেই, অহংকার নেই। নিষ্ঠুর দারিদ্র্যে নিষ্পেষিত হয়ে যাচ্ছে, তবু সব সময়ে পাবে নির্ধারিত হাসি। আর, এমন মজার, ওর হাত-পা চোখ-মুখ সব আছে, কিন্তু ওর বয়স নেই। ভগবান ওকে বয়স দেননি। দিন যায়, মানুষ বড় হয়, কিন্তু পবিত্র যে-পবিত্র সেই পবিত্র। নট-নড়নচড়ন। আজ যেমন ওকে দেখছি, পচিশ বছর পরেও ওকে তেমনি দেখব। অন্তরে কী সম্পদ, কী স্বাস্থ্য থাকলে এই বয়সের ভার তুচ্ছ করা যায় ভেবে দেখো।
নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে।
রহস্যের মধ্যে আমার যেমন বিড়ি ওর তেমনি খইনি। আর তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
সবাই হেসে উঠলাম।
সেই পবিত্র প্রবাসীতে কাজ করে। প্রবাসী চেন তো?
প্রবাসী চিনি না? বাংলা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকা।
কিন্তু নজরুল বলে, প্রকৃষ্টরূপে বাসি—প্রবাসী।
চারু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবাসীর তখন প্রধান কর্ণধার, এদিকে-ওদিকে আরো আছেন কজন মাঝিমাল্লা। আমার গল্প পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে উৎসুক। থাকি বাদুড়বাগান বো-র এক মেসে, চললাম কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট। সাধারণ ব্রাহ্মমন্দিরের পাশের গলিতে প্রবাসী-আপিস, গলির মাঝখানে ঝুলছে কাঠের ঢাউস সাইনবোর্ড। সেখান থেকে যাব বত্রিশ কলেজ স্ট্রিটের দোতলায়, মোসলেম-ভারত আপিসে, নজরুলের কাছে। সঙ্গে সর্বপ্রিয় পবিত্র। আমহার্স্ট স্ট্রিটে পড়েছি, অমনি পবিত্র সামনে কাকে দেখে গোকুল গোকুল বলে চেঁচিয়ে উঠল। আর যাই কোথা, ধরা পড়ে গেলাম। কথা কম বলে বটে কিন্তু অদম্য তার আকর্ষণ। যেন মন্ত্রবলে টেনে নিয়ে গেল আমাকে কল্লোল আপিসে, সেই এক মুঠো ঘরে। কল্লোল সবে সেই প্রথম বেরুবে, আদ্ধেক প্রেসে, আদ্ধেক কল্পনায়। সাহিত্যের জগতের এক আগন্তুক পত্রিকার জগতের এক আগন্তুকের দুয়ারে এসে দাঁড়ালাম। আজ তারিখ কত?
বাইশে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১, বৃহস্পতিবার।
সেদিনটা চৈত্রের মাঝামাঝি, ১৩২৯ সাল। এক বছরের কিছু বেশি হল। ঘরে ঢুকে দেখি একটি ভদ্রলোক কোণের টেবিলের কাছে বসে নিবিষ্ট মনে ছবি আঁকছে। পরিচয় হতে জানলাম ও-ই দীনেশরঞ্জন। বললে, কল্লোল আপনার পত্রিকা, যে আসবে এ-ঘরে তারই পত্রিকা। লিখুন—লেখা দিন। এমন প্রশস্তচিত্ততার সঙ্গে সংবর্ধিত হব ভাবতেও পারিনি। প্রবাসীর জন্যে লুকিয়ে পকেটে করে একটি গল্প নিয়ে চলেছিলাম। দ্বিরুক্তি না করে সেটি পৌঁছে দিলাম দীনেশের হাতে। দীনেশ একটি লাইনও না পড়ে লেখাটা রেখে দিলে তার দেরাজের মধ্যে। বললে, লেখা পেলাম বটে, কিন্তু তার চেয়েও বড় জিনিস পেলাম। পেলাম লেখককে। কল্লোলের বন্ধুকে। কল্লোলের সেই প্রথম সংখ্যার প্রথম গল্প আমার মা। আমি আছি সেই প্রথম থেকে।
বললাম, প্রবাসী আপিসে গেলে না আর সেদিন?
কোথায় প্রবাসী আপিস! নজরুলও বুঝি খারিজ হবার জোগাড়। চারজনে তখন আড্ডায় একেবারে বিভোর। তারপরে, সোনায় সোহাগার মত, এসে পড়ল রুটি, আলুর দম আর চা। এমন আড্ডার জয়জয়কার।