সম্পাদকের সঙ্গে রোজ তার দেখাও হয় না। তারা লেখার জোটপাট কবেন ভবানীপুরে বসে, প্রফ দেখেন ছাপাখানায় গিয়ে। কিন্তু ছুটির দিন অফিসে এসে হাজিরা দেন। সেদিন জিতেনবাবু অনুভব করেন তার রথের রশিতে টান আছে। মুঠো থেকে খসে পড়েনি আলগা হয়ে। অস্বাস্থ্যকে অস্বীকার করেই আনন্দে ও আতিথেয়তায় উদ্বেল হয়ে ওঠেন। আসে চা, আসে পবোটা, আসে জলখাবার। আপত্তি শোনবার লোক নন জিতেনবাবু।
কাগজ তো বেরুলো, কিন্তু লেখক কই?
প্রথম সংখ্যার প্রথমেই কামিনী রায়ের কবিতা—নিদ্রিত দেবতা জাগো। সেই সঙ্গে বিপিন পাল ও পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ। জ্ঞানাঞ্জন লিখলেন সংহতির আদর্শ নিয়ে। তারই ছাপানো নকল আশুড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল ব্রজেন্দ্র শীল আর রবীন্দ্রনাকে। আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ টেলিগ্রামে আশীর্বাণী পাঠালেন, তার বাংলা অনুবাদ ছাপা হলো পত্রিকার প্রচ্ছদে। আর রবীন্দ্রনাথ? এক পরমাশ্চর্য সন্ধ্যায় পরম-অপ্রত্যাশিত ভাবে তার এক অপূর্ব প্রবন্ধ এসে পৌঁছুল। সেই প্রবন্ধ ছাপা হল জ্যৈষ্ঠের সংখ্যাতে।
কিন্তু তারপর? গল্প কই?
বাংলাসাহিত্যের বীণায় যে নতুন তার যোজনা করা হল সে সুরের লেখক কই? সে অনুভূতির হৃদয় কই? কই সেই ভাবের সূত্রধর?
বিপিনচন্দ্র বললেন, নারান ভটচাজকে লেখ। টাকা চায় ভি-পি করে যেন পাঠায়।
নারায়ণ ভট্টাচার্য গল্প পাঠালেন, দিন মজুর।
একবার শরৎচন্দ্রের কাছে গেলে হয় না? শোষিত মানবতার নামে কিছু খুদকুড়া মিলবে না তাঁর কাছে?
কে জানে! তবু দুই বন্ধু জ্ঞানাঞ্জন আর মুরলীধর একদিন রওনা হলেন শিবপুরের দিকে।
বাড়ির মধ্যে আর ঢুকতে পাননি। শরৎচন্দ্রের কুকুর ভেলির তাড়া খেয়েই দোরগোড়া থেকে ফিরে এলেন দুই বন্ধু।
এমন সময় শৈলজার লেখা গল্প কয়লাকুঠি নজরে পড়ল।
কে এই নবাগত? মাটির উপরকার শোভনশ্যামল আন্তরণ ছেড়ে একেবারে তার নিচে অন্ধকার গহ্বরে গিয়ে প্রবেশ করেছে? সেখান থেকে কয়লার বদলে তুলে আনছে হীরামণি?
ঠিকানা জানা হল—রূপসীপুর, জেলা বীরভুম। চিঠি পাঠানো হল গল্প চেয়ে। শৈলজা তার মুক্তোর অক্ষর সাজিয়ে লিখে পাঠাল গল্প। নাম খুনিয়ারা।
এ গল্প সংহতির তারে ঠিক সুর তুলল না। মুরলীধর শৈলজার সঙ্গে পত্রালাপ চালাতে লাগলেন।
শৈলজা লিখে পাঠাল : নতুন উপন্যাসে হাত দিয়েছি। কারখানায় সিটি বেজেছে আর আমার আখ্যানও সুরু হল।
মুরলীধর জবাব দিলেন : ছুটির সিটি বাজবার আগেই লেখাট। পাঠিয়ে দিন। অন্তত প্রথম কিস্তি। পত্রপাঠ।
বাঙ্গালী ভাইয়া নাম দিয়ে শৈলজার সেই উপন্যাস বেরুতে লাগল সংহতিতে; পরে সেটা মাটির ঘর নামে পুস্তকাকৃত হয়েছে।
শৈলজা তো হল। তারপর? আর কোনো লেখক নেই? যজ্ঞের আর কোনো পুরোধা?
শুধু কেরানী আর গোপনচারিণী তখন প্রেমেনকে অতিমাত্রায় চিহ্নিত করেছে। মুরলীধর তাকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। বীরেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় নামে কলেজের এক ছাত্র (বর্তমান দিল্লীতে অধ্যাপক) সংহতির দলের লোক। ইস্কুলে আমাদের তিনি অগ্রজ, চিনতেন প্রেমেনকে। বললেন, আরে, প্রেমেন তো এ পাড়ারই বাসিলে, কোথায় খুজছেন তাকে মফঃস্বলে? আর এ শুধু হাতের কাছের লোক নয়, তার লেখাও মনের কাছেকার। সম্প্রতি সে বস্তিজীবন নিয়ে উপন্যাস লিখছে—নাম পাক।
মুরলীধর লাফিয়ে উঠলেন। কোথায় ধরা যায় প্রেমেনকে?
এদিকে মুরলীধর প্রেমেনকে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন আর প্রেমেন তার বাড়ির দরজা থেকে নিরাশ মুখে ফিরে যাচ্ছে।
কিন্তু ফিরবে কোথায়? গোকুল আর ধীরাজ চলে গেল যে যার দিকে, কিন্তু আমাদের তিন জনের পথ যেন সেদিন আর শেষ হতে চায় না। একবার শৈলজার মেস, শাখারীপাড়া রোড, পরে প্রেমেনের মেস গোবিন্দ ঘোষাল লেন, শেষে আমার বাসা বেলতলা নোচ-বারেবারে ঘোরাফিরা করতে লাগলাম। যেন এক দেশ থেকে তিন পথিক একই তীর্থে এসে মিলেছি।
বিকেলে আবার দেখা। বিকেলে আর আমরা আপনি নেই, তুমি হয়ে গিয়েছি। শৈলজা তার গল্প বলা শুরু করল।
আমার আসল নাম কি জানো? আসল নাম শ্যামলানন্দ। ডাকনাম শৈল। ইস্কুলে সবাই ডাকত শৈল বলে। সেই থেকে কি করে যে শৈলজা হয়ে গেলাম—
প্রায় নীহারিকার অবস্থা।
বাড়ি রূপসীপুর, জন্মস্থান অণ্ডাল মামাবাড়ি, আর—বিয়ে করেছি ইকড়া-বীরভূম জেলায়
বিয়ে করেছ এরি মধ্যে? কত বয়স? এই তেইশ-চব্বিশ। জন্মেছি ১৩০৭ সালে। তোমাদের চেয়ে তিন চার বছরের বড় হব।
বাবা ধরণীধর মুখোপাধ্যায়। সাপ ধরেন, ম্যাজিক দেখান—
তাকালাম শৈলজার হাতের দিকে। তাইতেই তার হাতের এই ওস্তাদি। এই ইন্দ্রজাল।
বিশেষ কিছুই করতে পারলেন না জীবনে। মাকে হারিয়েছি যখন তিন বছর বয়স। বড় হয়েছি মামার বাড়িতে। দাদামশায় আমার মস্ত লোক। জাদরেল রায়সাহেব।
তাঁর নাতির এই দীনদশা! আছে এই একটা থুখবরা ভাঙা মেসে! হাঁটতে-চলতে মনে হয় এই বুঝি পড়ল হুড়মুড় করে। দোতলা বাড়ি, পূর্ব পশ্চিমে লম্বা, দোতলায় মুখের দিকে কাঠের রেলিং দেওয়া একফালি বারান্দা, প্রায় পড়ো-পড়, জায়গায়-জায়গায় রেলিং আলগ। হয়ে ঝুলে পড়েছে। উপরতলায় মেস, নিচে সাড়ে বত্রিশ ভাজার বাসিদে। হিন্দুস্থানী ধোপ, কয়লা-কাঠের ডিপো, বেগুনি-ফুলুরির দোকান, চীনেবাদামওয়ালা কুলপিবরফ ওয়ালার আস্তানা। বিচিত্র রজ্যি। সংহতির সংকেত!
দাদামশায় তাড়িয়ে দিলেন বাড়ি থেকে। বাঁশরীতে গল্প লিখেছিলাম আত্মঘাতীর ডায়রি বলে। গল্প কি কখনো আত্মকাহিনী হতে পারে? তবু ভুল বুঝলেন দাদামশায়, বললেন, পথ দেখ।